সোমবার, ২৭ মে, ২০১৩

নস্টালজিয়া

-আচ্ছা, এই এলাকায় কদম গাছ কোথায় পাব?

লীলাবতির এমন প্রশ্নে রোকন বিস্মিত হয়ে গেছে। সে মনে করতে পারল না কখনো কেউ তাকে এমন উদ্ভট প্রশ্ন করেছে! ... তাই সে না শোনার ভান করল।

লীলাবতি এবার গলার স্বর একধাপ বাড়িয়ে জানতে চাইল ...

-এই যে ভাই, এই এলাকায় কদম গাছ কোথায় পাওয়া যাবে?

রোকন এবার মাথাটা কিঞ্চিৎ ডান দিকে ঘুরিয়ে বলল 'আফা, আমারে জিগান?'

-হ্যাঁ! ... আপনি ছাড়া আর তো কেউ নেই আশেপাশে! আর আমাকে দেখে কি আপনার পাগল মনে হচ্ছে যে একা একা কথা বলে? ... বলল লীলাবতি।

- জ্বে না আফা! তয় ফাষ্টে বুজিনাই, কি কইতে কি কমু, তাই কিছু কইনাই। ড্যাবড্যাব করে তাকায় রোকন পেছনে।

-আরে আরে সাবধানে যান, করছেন কি! দিলেন তো সব ভিজিয়ে!

-স্যরি, আফা ... ঝটপট বলে রোকন।

-অসুবিধা নেই, আচ্ছা, জানেন আপনারা যে, যখন তখন বৃষ্টি নামে, পর্দা কেন রাখেন না? একরাশ বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে লীলাবতি। ওর কালো ফ্রেইমের মোটা চশমার পেছনে ততোধিক কালো; পেলব; পুষ্ট ভ্রুযুগল বক্ররেখার মত হয়ে গেছে বিরক্তিতে। আর সে মনে মনে ইচ্ছে পোষণ করে, জিপ গাড়িটার কাঁচ সে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইঁট ছুঁড়ে ... চুড়মাড় ভেঙ্গে পড়ছে কাঁচ, আর চালকের মুখ পাংশুটে হয়ে গেছে। কিন্তু লীলাবতি জানে, ইঁট ছুঁড়ে মারতে সে পারবে না কোনদিন, তাই তার ভ্রুগুলো আরো বাঁকা হয়ে যায় ক্ষোভে। এই গাড়িওলা মানুষেরা খুব ইন্সেন্সিটিভ হয়, ভাবে লীলাবতি। ভাবতে ভাবতে হাত-পা ঝাড়া দিতে থাকে।

এর মাঝে বেশ অনেকটা রাস্তা পাড় করে এসছে রোকন, রিক্সা চলছে দারুণ গতিতে। ঝুম ঝুম বৃষ্টি পড়ছে খোলা রাস্তায়, সাত মসজিদ রোডে কোন জ্যাম নেই দুপুরের এই স্কুল ছুটির সময়টাতেও! ঠান্ডা হাওয়া মাধুর্য্য ছড়াচ্ছে লীলাবতির মনে, সে বৃষ্টির সৌন্দর্য্যে আনন্দিত হতে হতে হারায় ভ্রুর বক্রতা। ফুরফুরে হয়ে ওঠে মন তার, বৃষ্টিবাতাসের মত!

-লীলাবতি বলে, ভাই, বললেন না! কদম গাছ কোথায় মিলবে?

-আফা, আপনে কি ডাকায় নতুন আইসেন?

-উহু ... বলে লীলাবতি, তবে এই এলাকায় নতুন।

-আইচ্ছা, সামনেই একটা কদম গাছ পড়ব। যাইবেন?

-'হ্যাঁ, ওখানেই নিয়ে যান।' লীলাবতি এ বছর কদম দেখেনি। সে পুরো একটা বছর কদম কালের অপেক্ষায় থাকে, আজ সেই অপেক্ষা পূরণ হবার দিন, ভাবতেই ভাল লাগে তার। আনমনে প্রশ্ন করে রোকনকে, 'ভাই, আপনার নাম কি?' রোকন যেন আরো অবাক হয়। মুখে যদিও নাম বলে তার ... লীলাবতি থামে না, সে জানতে চায়, কোথায় তার বাড়ি, পড়াশোনা করেছে কিনা, বাড়িতে তার আর আছে কে কে? ... রোকন সব ঠিক উত্তর দেয় তার। শুধু কেন যেন তার বলতে ইচ্ছে করে না, এই আফার কাছে, ময়নার নাম (ময়না তার হবু বউ, এক বাড়িতেই থাকে)!

রিক্সা এসে থামে ধানমন্ডি সাতাশের মাঝামাঝি। 'এই পার্ক দইরা নাক বরাবর আইটা গেলে আফা দ্যাকবেন কদম গাস।' বলে বিরাট এক হাসি দেয় রোকন, তার কেন যেন মনে হয়, এমন সুখের কাজ করেনি সে জীবনে আর কোনদিন! ... লীলাবতি ভাড়া দিতে দিতে গলা চড়িয়ে প্রশ্ন করে, 'আচ্ছা রোকন ভাই, আপনি সারাদিনে কত রোজগার করেন?' ... তারপর রোকনের খোলা মুখ থেকে শব্দ বেরুবার আগেই বলে বসে, 'আমি যদি আপনাকে একদিনের খরচ দিয়ে দেই, আপনি আমার সঙ্গে এখন ওই কদম গাছের কাছে দাঁড়াবেন গিয়ে?  ...

এভাবেই রোকন আর লীলাবতি কোন এক বৃষ্টি দুপুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাক ভেজা হয়ে কদম দেখেছিল। লীলাবতি দেখেছিল কদমফুলের গা ধুয়ে নেমে আসা টুপটাপ জল, পাতার সবুজ আর রোকন দেখেছিল আফার চোখে মুখে ফুটে ওঠা সুখ সুখ অনুভূতি, বৃষ্টি ফোঁটায় স্নাত।







বুধবার, ২২ মে, ২০১৩

খোলা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঝুম বৃষ্টি অনুভবের কথা ভাবলেও শিহরণ লাগে।
মাঝে মাঝে একা রাত অর্ধেক হলে পরে ঘরের ঘোর খুলে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে পথে,
তারপর সকাল হবে কি না হবে সেই চিন্তাও আসে না কখনো 
... এমন করে হেঁটে হেঁটে কোন দূর চায়ের দোকানে বসে গল্প গুজব,
গামছার আড়লে খেটে খাওয়া মানুষের কাঁধ, উচ্ছল হাসি ... 
সে হাসিতে মায়া আছে খুব, কিন্তু তা মায়ার বাঁধন থেকে মুক্ত বড়! 
মাঝে মাঝে তুমি প্রশ্ন করার আগেই তোমাকে জানাতে ইচ্ছে করে ভালবাসি কিনা,
তাই মাঝে মাঝে তুমি চুপ করে থাকো আর আমি জিজ্ঞেস করি, ভালবাসো? ...
এমন হয়, কোন গান শুনে মনে হয়, এই গান শুনে শুনেই মরে যাব, এই গান শুনতে শুনতে
আরো পবিত্র হব, বিষাদের বিবমিষা লেগে থাকবে গায়ে
শরীরের ত্বক চিড়ে ঢুকে পড়বে আত্মায় অলি গলিতে
সেই গান তোমাদের সবাইকে শোনাব!
কখনো ফেলে আসা কার কথা মনে পড়ে
মনে পড়তেই মনে পড়ে যায়, হায়! কত পথ হাঁটা ছিল বাকি!
মাঝে মাঝে তার এক ইশারায় চোখের বাঁধন খুলে মাঠের শেষ কোণে গিয়ে মুখ লুকাই।

শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৩

দৃশ্যপট মহাখালী ফ্লাইওভার। এক ঘন্টা যাবৎ রেজা জ্যামে আটকে আছে। গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে ঢাকা গাড়ির গরমেও অগ্নিকূপে পরিণত হয়। ছুটির দিনে রেজা বাসায় ঘুমাতে পছন্দ করে। কিন্তু আজ বেরোতে হল, মামার বাসায় আগের রাতে আট হাজারে কেনা ইলিশ মাছের  কোপ্তা দিয়ে আসার জন্য। সে ভাবে, 'গাড়ি থাকতে চিন্তা কি? যাব আর আসব' ... কিন্তু ছুটির দিনেও রাস্তায় গাড়ির জ্যামে আটকে রেজা রাগে দুলতে থাকে। যদিও গাড়ির বাইরে রাস্তায় হেঁটে চলা জীবন যাদের, তাদের তুলনায় রেজা বেশ আরামেই আছে, অন্তত ভ্যাপসা গরমে এসির ঠান্ডা বাতাস আর হাল্কা ভলিউমে হৃদয় খানের গান পথিকের জীবন থেকে তো আলাদাই করেছে তাকে !

শুক্র আর শনিবার ছাড়া সাপ্তাহিক বাকি দিনগুলোতে রেজা অসম্ভব ব্যস্ত। নামী ব্যাংকে বড় পোস্টে চাকরিজীবী সে। মনে মনে তার চাইতেও বেশি প্রণোদিত রেজা, তার মোটা অংকের বেতনের কথা ভেবে। জীবনের কোথাও দৃশ্যত কোন ক্লেদ নেই তার! ঘুষখোর বাবার রেখে যাওয়া অঢেল সম্পত্তি, ঢাকা ইয়ুনিভার্সিটির বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিগ্রী, প্রেমের সফল পরিসমাপ্তি বিয়েতে, আজ্ঞাবাহী বৌ, যে ঘরে-বাইরে রেজার পাশে শোভা বর্ধনের জন্য যথেষ্ট, দুটো ফুটফুটে ছেলে মেয়ে, ঢাকায় দাপিয়ে বেড়ানোর জন্য দামী গাড়ি, শহরের নামী এলাকায় বাড়ি ... ছেলে মেয়েদের ইংলিশ স্কুলে পড়াশোনা।

রেজা হৃদয় খানের গান শোনে আর ভাবে মেয়েটাকে তার গান শেখাতে হবে, পাশাপাশি আর্ট স্কুল আর নাচের ক্লাস। ইদানীং এসব না করলে বসদের সঙ্গে আড্ডায় পেরে ওঠা যায় না। মেয়েকে সামলে নেওয়ার জন্য বৌ তো আছেই। সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব এ সমাজে আছে, কিন্তু বখে না গেলেই হল! বাসায় হুজুরের কাছে কুরাআন  শিক্ষাও চলবে। তার মনে হয়, ধর্মীয় শিক্ষা মেয়েকে বখে যাওয়া থেকে বাঁচাবে। মেয়ে বড় হলে যদি গানের সিডি বের করতে চায়, অর্থের অভাব হবে না। রেজা ভাবে আর হাসে ... তার ছোট্ট মেয়ে বড় হবে, গান করবে। নাচ আর ছবি আঁকাটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাওয়া ভাল। ওগুলো মানুষের ছোটবেলার সময় কাটানোর সেরা অনুষঙ্গ হতে পারে, কিন্তু বড়বেলার জন্য রিস্কি!

মটরবাইকের হর্ণে তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে। ঢাকা শহরে এই হয়েছে এক জ্বালা। যার তার হাতে পয়সা চলে গেছে, যে সে চাইলেই যান কিনে ফেলে আর রাস্তায় জ্যাম বাঁধায়, ভাবে রেজা বিরক্তিভরে। সভ্য সমাজে চলার নিয়ম কানুন এদের অজানা! রেজা পারলে সব্বাইকে এক হাত দেখে নেয়, এইসব ছোটলোক, নির্ঘাত কম মাইনেতে ছাপোষার মত বেঁচে থাকে, আবার রাস্তায় রাজা বনতে চায়, রেজা গালি দেয় লোকটাকে 'ব্যাটা খা*** পুত'!

আজ শনিবার। অর্ণব চায়নি বেরোতে। তার অফিস বনানীতে। একটা অ্যাড ফার্মের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর সে। প্রচলিত পড়াশোনায় তার অরুচি। তার স্বপ্ন ছবি বানানো, বিটার মুন দেখার পর থেকে তার জীবনে অদ্ভূত বাঁক আসে। সে বিভোরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয় নিজেকে!

অর্ণব বোদলেয়ার পড়ছিল, 'আমি ভালবাসি ওই আশ্চর্য মেঘদল ...'  এর মাঝে আসিফের ফোন। (আসিফ তার অফিসের ডিরেক্টর)

আসিফঃ পাগলা, কি করিস?
অর্ণবঃ শেষ মেঘ দেখেছি কবে, মনে পড়ে না আসিফ ভাই।
আসিফঃ আকাশে খুঁজতে খুঁজতে একবার একটু ঘুরে যা।
অর্ণবঃ জরুরি কিছু?

আসিফ জানায়, ব্লুজ কালারের বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্টটা খুব দরকার। ক্লায়েন্ট এসছে। অর্ণব যেহেতু আইডিয়া জেনারেইট করছে, তারা ওর সঙ্গে আলাপ করতে চায় জরুরি ভিত্তিতে। তাদের কিছু পরিবর্তন চাই।
অর্ণব মেঘদলের ওড়াউড়ি থেকে ছিটকে এসে পড়ে ক্লায়েন্টের পছন্দ অপছন্দের ভাঁড়ারে। বিষাদে, অপারগতায় আবারো কুঁকড়ে ওঠে সে ভেতরে। কম্প্রোমাইজ হয়ত করতে হবে আবারো স্ক্রিপ্টে, ভাবতে তার ভাল লাগে না আর। আসিফকে শুধু বলে দেয় 'আসছি।'

ঘড়ির কাটায় একটা চল্লিশ, বাইক নিয়ে আসিফ যখন মোহাম্মদপুর থেকে বেরিয়েছে। আর মহাখালী ফ্লাইওভারে রেজার গাড়ির পাশে এসে সে যখন জায়গা চাচ্ছে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, তখন বাজছে তিনটা দশ। প্রচন্ড গরমে, রাস্তার জ্যামে হঠাৎ তেঁতিয়ে ওঠা অর্ণব জীবনের গন্তব্য নিয়ে ভাবতে থাকে আর বিচলিত, বিরক্ত হয়। সে দেখে রাস্তায় তার বয়স্ক একটি ছেলে বাদাম বিক্রি করছে, আরো ছোট একজন মিনারেল ওয়াটার। সে মানিব্যাগ খুঁজে ত্রিশ টাকা বের করে, পানি কেনে, বাদাম কেনে। খেটে খাওয়া মানুষ তার বড় প্রিয়। তার চাইতেও শ্রদ্ধা করে সে তাদের ঘাম। ওরা জীবন নিয়ে কি ভাবে? ওদের তুলনায় নিজেকে বড় বিলাসী মনে হয় তার আর মনে মনে তুচ্ছ মনে হয় তাকে। ও ফিরে যায় আশ্চর্য মেঘদলে ... হায়, এরা শেষ কবে মেঘ দেখেছিল? অথবা মেঘ দেখার সাধ কি মনে জাগে এদের?

... রেজার কন্ঠে জ্যামের নগরীতে ফেরে অর্ণব।

রেজাঃ কি ভাই! কত বড় মাস্তান হইছেন?
অর্ণবঃ (তীর্যক প্রশ্ন উপেক্ষা করে বলে) আপনি ডানে সরে গেলে আমি অনায়াসে চলে যেতে পারি, তাড়া আছে।
রেজাঃ আপনের তাড়া আছে, তাড়া তো ভাই আমারো, কিন্তু বাইক নিয়া প্রাইভেট কারের সঙ্গে মশকরা করবেন তা তো বেমানান!
অর্ণবঃ (বিস্মিত আর রাগ চেপে জানতে চায়) ভাই, বুঝলাম না!
রেজাঃ আমার এই গাড়ির দাম জানেন কত? এইটারে পিছে ফালায়া আগে যাবেন, চিন্তাটা পছন্দ হইল না। দিলাম না জায়গা। যান দেখি ... !

অর্ণব মুহুর্তে তার বাবার মুখটা মনে করে। একজন সৎ, ভালো মানুষ। কিন্তু মানুষের চতুরতা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তাদের ওপর ভরসা করে ব্যবসা দাঁড় করানোর নিস্ফল চেষ্টা করে এখন নিঃস্বপ্রায়।  একজন স্বপ্নবাদী সে, তাই এখনো স্বপ্ন দেখেন বড় বড়। বাবা শেষমেষ তাদের শখের গাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগেও প্রয়োজন হলে বাবাকে লোকাল বাসে জার্নি করতে হয়েছে তাই। ইদানীং বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় অর্ণব বাবাকে বেরোতে নিষেধ করে। তার পাশে গাড়িতে যে লোকটা, তার সঙ্গে বাবার পার্থক্য খুঁজতে থাকে অর্ণব।

রেজাঃ (গাড়ির কাচ বন্ধ করতে করতে) যত্তসব আবোল তাবোল ছাগলের জায়গা হইসে এই শহর।

রেজার শেষ শব্দগুলো অর্ণবের মাথায় ঝিম ধরিয়ে দেয়। সে বাইক স্টার্ট করে আর এগিয়ে যেতে থাকে। ততক্ষণে জ্যাম ছুটতে শুরু করেছে। কিন্তু ফ্লাইওভার পাড় হয়ে সামনে এগোতেই গাড়িটি তাকে একপাশে আটকে রেখে চলতে থাকে! রেজা আর সহ্য করতে পারে না। সে গতি বাড়িয়ে গাড়িটাকে রাস্তার ডানদিকে চাপতে বাধ্য করে। তারপর সামনে এগোয়।

অফিসে পৌঁছে অর্ণব দেখে আসিফ ভাই আর ক্লায়েন্ট তার জন্য অপেক্ষা করছে। ক্লায়েন্টের ডিমান্ড স্ক্রিপ্টে ছোট্ট মেয়ের চরিত্র বাদ দিয়ে কোন তরুণীকে ইন করানো। আর সেই চরিত্রের রুপায়ন করাতে চায় তারা কোন নায়িকাকে দিয়ে। ভদ্র ভাষায় স্ক্রিপ্ট পরিবর্তনে অপারগতা জানায় অর্ণব, ক্লায়েন্ট নাছোড়বান্দা! আসিফ ভাই কনফারেন্স রুমের টেবিলের তলা থেকে অর্ণবের হাতে টোকা দিয়ে অনুরোধ করে চেপে যেতে, কারণ এই পার্টি তাদের সঙ্গে পুরো তিন বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করার আগ্রহ দেখাচ্ছে, যেটা তার প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভজনক। অগত্যা চুপ করে যায় অর্ণব।

বিকেলের রোদে অফিস থেকে বেরিয়ে মোড়ের দোকানে গিয়ে সিগ্রেট ধরায় সে। হঠাৎ মেঘদল চোখে পড়ে তার। সে মনে মনে বিড়বিড় করে ওঠে 'আশ্চর্য মেঘদল/ কালে কালে কত তুমি এলে?' চাপা দীর্ঘশ্বাস মনের কোণ থেকে বেরোয়, মেঘদল তাকে চুরি করে এগিয়ে যায় কিনা, অর্ণব জানে না। সে পা বাড়ায়, মটর বাইকে স্টার্ট দিয়ে ভাবে চারুকলা যাবে। এগোতে থাকে সে। কিন্তু কিছুদূর যেতেই লুকিং গ্লাসে সে দেখে ওই গাড়িটি ফলো করছে তাকে! অর্ণব প্রশ্রয় না দিয়ে এগোতে থাকে, তার বিভোরের কথা মনে পড়ে। সে ভাবে, এত বড় শহরে কেউ নেই, মনের বিষাদগুলো অধিকার করে নেয় এমন!

এরই মাঝে ঘটে ঘটনাটা। রেজা সুযোগ বুঝে একটা লোকাল বাস আর তার গাড়ীর মাঝে ফেলে দেয় অর্ণবকে। প্রবল এক ঝটকায় তাকে বাসের গায়ে লাগিয়ে দিয়ে সামনে চলে যায়। অর্ণব খেই হারিয়ে রাস্তায় পড়ে। তার বাইক থেকে ছিটকে যায় সে কয়েক হাত দূরে। কপাল গড়িয়ে রক্ত পড়তে থাকে, জ্ঞান হারায় সে, কিংবা হয়ত তার শেষ নিঃশ্বাসকে সঙ্গী করে নিয়েছিল মেঘদল!

(সেই রাতে রেজা ঘরে ফিরে দেখে, তার ছেলেটা জ্বরে কাতরাচ্ছে বিছানায়। চিৎকার করে বলে 'বাবা, মেঘ আসছে, মেঘ ... দৈত্যের মত, আমাকে নিয়ে গেল বাবা।' ... আর বাইরে কালবৈশাখী ঝড়। সে মোবাইল ফোনে চেষ্টা করে নেটওয়ার্ক পায় না, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে করে ঘর থেকে কোলে তুলে নেয় সাড়ে  চার বছরের শিশুপুত্রকে। কিন্তু বেরিয়ে দেখে তার গাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে গেছে ঝড়। সেটি আর চালাবার জো নেই। গাড়ির এমন পরিস্থিতি দেখে রেজা আবার রেগে ওঠে। সে এই দেশের প্রকৃতিকে গালি দিতে থাকে, জোরে জোরে বলতে থাকে 'বা** এক দেশ! বা** বৈশাখ।'  আর হঠাৎ লক্ষ্য করে, তার শিশুপুত্রের নিস্তেজ দেহ লুটিয়ে পড়েছে ...)

... কিন্তু এমন হয় না। যেমনটা হতে থাকে প্রতিনিয়ত ...

 রেজা  তার দামী গাড়ি দিয়ে অর্ণবকে চাপ দিয়ে মনের অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেয়েছিল, ভেবেছিল, গেলাম জিতে। সে মনে মনে হেসে উঠেছিল ভেবে, ফকিরটার জায়গা এবার হবে আস্তাকুঁড়ে। ঠ্যালা সামলা ব্যাটা, আমার গাড়ির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার ঠ্যালা সামলা। ব্যাটা, রাস্তায় চালাবি বাইক, আর আমি চালাই প্রাইভেট কার। তোর সময় বা জীবন কি ব্যাটা আমার থেকে বড়! ... সে বেসুরো গলায় গায়, 'চাই না মেয়ে তুমি অন্য কারো হও, পাবে না কেউ তোমাকে, তুমি কারো নও ...'