রবিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৩

কেন এমন করে কাঁদো?


জীবন, কেন এমন করে কাঁদো?
তোমার কাঁধে অনেক বোঝা, সে আমি জানি।
পরতে পরতে জমাট বাঁধে রক্ত, গুমোট অভিমানে।
চোখের পলকে যদি মনে পড়ে বিগত দিনে
উচ্ছল চঞ্চলতায়  শৈশব করেছ পাড়;
তবে হেসে হেসে গাছের সবুজ পাতায়-
বনানীতে, ঘাসের বুকেতে ওম দিয়ে
জানান দাও, আজ তুমি বড় খুশি!
তবে কি জানো না, এভাবেই রক্তের দাগ
ধুয়ে মুছে কালিমা করবে অতিক্রম তোমায়?

জীবন, কেন এমন করে বাঁচো মুখ লুকিয়ে?
জীবন, কেন এমন করে কাঁদো?

বেহিসেবে যায় যদি কিছুটা অনেকখানি সময় তোমার
সে সময় তোমারই মুক্তির দাবী নিয়ে
মিছিলে শ্লোগান তোলে।

দেখো, আকাশ মেঘেদের সারিবদ্ধ করে হাঁটতে শেখায়!
দেখো,সমুদ্র ঢেউ নিয়ে এক্কাদোক্কা খেলে সুনিপুণ মুহুর্ত রাঙ্গিয়ে!
দেখো, অবিরাম কৌশলহীন আলিঙ্গন ফিঙে পাখিদের!
ওদের কোথাও কোন শুরু নেই, শেষ নেই
ওদের কোথাও কোন আক্ষেপ নেই
ওদের কোথাও কোন মাঝপথে থেমে যাওয়া নেই।

জীবন, তোমার রোদমাখা শরীরের পাশাপাশি আমিও আছি তো ঠিক
কেন এমন করে কাঁদো? ...


সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০১৩

ইচ্ছে 

আমি ধীরে হারাব, মেঠোপথে
ধূলায় গা ধুয়ে-নেয়ে নিব
নিষ্পাপ পুকুরের জলে
মিষ্টি রোদের ওম মেখে নিতে নিতে 
সন্ধ্যা দেখব কোন পাড়াগাঁয় পিদিম জ্বালিয়ে

শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৩



যোগাযোগ



মিনার্ভা ফোন একবার হাতে নিচ্ছে, খুঁজে বের করছে নাম্বারটা ... আবার ভাবছে, কথা বলবে কিনা। এভাবেই প্রায় আধ ঘন্টামতন কাটল। এমনই হয়, ভাবতে ভাবতে, দ্বিধায় তার বেলা অবেলা হয়ে যায়, অনেকটা সাহস যখন সে সঞ্চয় করে, তখন মাঝরাত। তাই কথা বলা হয় না। কিন্তু মিনার্ভা জানে, তাকে বলতেই হবে কথাগুলো। এমন নয়, না বললে পৃথিবীর খুব একটা ক্ষতি কিছু হবে, মৃদু বাতাসে গাছের পাতা দুলে উঠবে না, ঘাসের সবুজ রং ম্রিয়মাণ হবে। এমন নয়, তার অথবা অনন্যর সময় থমকে দাঁড়াবে, তবু মিনার্ভা জানে, যদি সে না বলতে পারে কথাগুলো, তবে মনের এক কোণে যে ব্যাকুলতা, তা থেকে মুক্তি মেলা ভার। অথচ মিনার্ভা ছাড়া আর কে জানে, এই ব্যাকুলতাই তার একমাত্র স্বপ্ন!

তবু সূর্য্য যেমন শ্রাবণ মেঘের ভেলার সঙ্গে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হলে ইচ্ছে করেই রশ্মি ছড়ায়, তেমন করেই মিনার্ভা কথাগুলো বলতে চায় অনন্যকে, তাই শ্রাবণের টুপুর টাপুর বৃষ্টিবেলায় অনন্যর ফোন বেজে ওঠে। কিন্তু এমন মুহুর্তেই মিনার্ভা আবার দ্বিধায় পড়ে, হয়ত ফোন না করলেই ভাল হত, হয়ত আরেকটু গুছিয়ে নিতে পারত নিজেকে মনে মনে। ও যে একদম জানেই না, কি দিয়ে শুরু হবে কথা? মিনার্ভা বা অনন্য কখনো তো কথাই বলেনি এর আগে! এমন কাঠপোড়া ক্ষণেই মিনার্ভার সমস্ত শরীর হিম হয়ে যায়, অনন্যর কন্ঠস্বর শোনে সে, 'হ্যালো!' ... মিনার্ভা ভাবে, এমন নিঃশব্দ ক্ষণ পৃথিবীতে নেই আর। যেন একসঙ্গে চারটে ফুলদানী ভেঙ্গে পড়ছে, অথচ কোন শব্দ হচ্ছে না, শুধুই তার হৃদয়ের উথাল পাথাল ধুকপুকানি, অনন্য সেটা টের পেয়ে যাচ্ছে। মিনার্ভা আকুল হয়ে চাইছে, অনন্য সেটা টের না পাক, অথচ এই হাড়হাভাতে নিঃশব্দ সময় তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে একটা সকরুণ আদর প্রত্যাশী বেড়ালের মত অসহায় করে ফেলেছে অনন্যর সামনে!

গ্রীষ্ম দুপুরে মাটি ফেটে চৌচির বিরান মাঠের কথা মনে পড়ে মিনার্ভার, একটা কোন ছায়া পেত যদি, ওম নিত সেখানে।

'হ্যালো, কে বলছেন?' অনন্যর আওয়াজে ওর সম্বিৎ ফেরে।

মিনার্ভা সেই ক্ষণগুলোতে ভাবে, এত দৃপ্ত আওয়াজ অনন্য কোথায় পেল? অথচ সেই আওয়াজেই মনে হয়, তানপুরা বাজছে; মনে হয়, এক পশলা বৃষ্টির ঝাপটা লাগল মুখে! স্থির হয় মিনার্ভা, বলে, 'কেমন আছেন আপনি? আমি মিনার্ভা বলছি।' আর চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করে অনন্যর মুখটা, অনন্য কি হাল্কা হাসিতে অভ্যর্থনা জানাল ওকে? নাহ, কিছুতেই সে বুঝে পাচ্ছে না, অনন্যর মুখটা এখন কেমন? ... ওপাশ থেকে অনন্য বলে, 'আমি ভাল আছি। তুমি?' ... মিনার্ভা অনন্যর 'তুমি'তে এসে থামে, ওর আরো বহুবার অনন্যর কন্ঠে তুমিটাই শুনতে ইচ্ছে করে, অনন্যর মুখে তুমি যেন পাশাপাশি বসে থাকা নিরন্তর, একসঙ্গে নিরব বাতাসের গন্ধ নিতে নিতে দিগন্ত দেখা।

কিন্তু এরপর আর যে কথা এগোয় না! দুই প্রান্তেই নিরবতার এক সূক্ষ রেখা টানা। দু'জনেই জানে, এই রেখা কল্পনা প্রসূত নয়, এখানেই ওদের থেমে যাবার নিয়ম ... অথচ কতই না কথা আছে জমে, থাকে অব্যক্ত। তবে মিনার্ভা আজ জানে, সে থামবে না। তাই ও-ই ভাঙ্গে নিরবতা।

বলে, 'শেষ আপনাকে দেখেছিলাম সবুজ রং'য়ের পাঞ্জাবীতে। দিনটা আপনার মনে আছে?'

অনন্য কি বলবে ভাবে খানিকটা। মিনার্ভা থামে না, বলে ... 'আমি জানি, আপনার ঠিক মনে আছে। কিন্তু আমি এও জানি, আপনি কিছু বলবেন না। তবে আজ জানা কথাগুলোকে অজানা করে লুকোচুরি করব বলে আমি আপনাকে ফোন করিনি। আপনার কিছু সময় আমার কাছে রয়ে গেছে, আমি ভাবছি সেগুলো পৌঁছে দিব কেমন করে। একদিন তাই সময় দেবেন?' এক নিঃশ্বাসে মিনার্ভা বলে ফেলে কথাগুলো, হঠাৎ সে বুঝতে পারে, জমাট বেঁধে যে লুকোচুরি সামলাতে চেয়েছিল তাকে, তা যেন নিমিষে উড়ে গেল শূণ্যে। মিনার্ভা কখনো ভাবেনি, অনন্যের প্রতি তার যে সম্মোহন, এই আগল তাকে এমন মুক্ত শব্দগুলো বলবার সাহস এনে দেবে!

অনন্য বড় সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ে। এত বছর পরে কেন মিনার্ভার ফোন? কোন সময় রয়ে গেছে তার যা সঞ্চয় করেছে মেয়েটা? তিনদিন ঠিক গুণে গুণে তিনদিন অনন্য মিনার্ভাকে দেখতে পেয়েছিল।  তিন বছরের ওই তিনটা দিনের মায়ায় কি অনন্যও ডোবেনি? অনন্য ভেবেছে বহুবার, নিরবতার টানাপোড়েন ঘুচিয়ে নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা। কিন্তু এক পা বাড়াতে গিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে পড়েছে সে ক্রমশ ... দ্বিধায়, ভয়ে, আড়ষ্টতায় ... যদি মিনার্ভা সব শুনে হেসে ফেলে? যদি মিনার্ভা দুষ্টু চোখের ইশারায় বলে, 'অনন্য, তুমি আমার কাছে হেরে গেলে।' অনন্য তাই জানায়নি মিনার্ভাকে, রোজ রাতে ঘুমোতে গেলেই মিনার্ভা চুপ করে এসে বসত অনন্যর পাশে, ওর স্নিগ্ধ; নিশ্চিত হাত রাখত কপালে। আর সেই হাতের ভাঁজে হাত রেখেই অনন্য সকাল দেখত। মিনার্ভা কি তবে টের পেয়ে গিয়েছিল সব? তাহলে সে কেন ভাঙ্গেনি নিরবতা? মিনার্ভাকে তো কখনোই অমন ছাঁচে ফেলতে পারে না অনন্য! মিনার্ভা তার দেখা সৌন্দর্য্যের এমন এক উদাহরণ যার জন্য অনন্য সব দ্বিধা ঝেড়ে শংকামুক্ত হতে পারত, যে একবার হ্যাঁ বলে হাত বাড়ালে অনন্য ছুটে যেত। ঘর বানাত! ...

ওপাশ থেকে অনন্য মিনার্ভার কথা শুনতে পায়, 'হ্যালো, আপনি আছেন? অনন্য বলল, 'হ্যাঁ, আছি।' মনে মনে ভাবল, 'মিনার্ভা, এখানেই থেমে যাও তুমি, আর পা বাড়িও না। কেন অকারণে পেছন ফিরে যাওয়া। আমাদের এই নিরবতা বেশ তো ছিল, আমিও তা জানি, আজ জেনে গেলাম, জানতে তুমিও। নয়ত এমন অধিকার নিয়ে কে বলতে পারে নিঃসংকোচে, আমার কিছু সময় তার কাছে আছে!'

মিনার্ভা ফোনের অপর প্রান্তে হেসে ওঠে, অনন্য ভাবে, চাঁদের রুপোলি আলোর মত মায়াময় দেখাচ্ছে মিনার্ভাকে। 'চুপ করে আছেন কেন এখনো? আজ তো আমিই চাইছি একটু সময়!'

অনন্য বলল, 'বেশ তো! বল, কবে, কখন, কোথায়?'

মিনার্ভা বলে, 'আপনার বাসার নিচে আমি দাঁড়িয়ে আছি। জানালায় এসে দাঁড়ালে আমাকে দেখতে পাবেন। আর যদি নিচে নামতে পারেন, তো আমরা কিছুদূর হেঁটে যেতে পারি।'

অনন্যর সমস্ত অনুভূতি একত্রিত হয়ে যেন দ্রিম দ্রিম বাজতে থাকে। অনন্যর ভীষণ রাগ হয়, ভাবে, মিনার্ভা, তুমি এমন কেন? এমন সাহস কোথায় ছিল তোমার? আমায় কেন বঞ্চিত করলে তুমি তবে? কিন্তু তারপর নিজেকেই ভর্ৎসনা করে সে। গ্লানিময় মনে হয় গোটা জীবন, সেও কি লুকায়নি নিজেকে! অস্ফুট স্বরে বলে, 'আসছি।'

সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে অনন্যর মনে হয়, আট বছর হাতের মুঠোয় করে নামছে সে, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, আজকের এই সন্ধ্যা তবে হোক সময় ফিরিয়ে দেবার।

সোডিয়াম লাইটের আলোয় অনন্য বুঝতে পারছে না, কি রং শাড়ি পড়েছে মিনার্ভা। তবে বৃষ্টির ছাটে ওর গা ভিজে গেছে, রাস্তার ওপাশে মিনার্ভা দাঁড়িয়ে। অনন্য বহুবার মিনার্ভাকে এভাবে আঁকতে চেয়েছে, পারেনি। আজ বৃষ্টিস্নাত মিনার্ভাকে দেখে মনে হল, এই মেয়েকে ছুঁতে গেলে যতটা শুদ্ধতার প্রয়োজন, তা বুঝি নেই ওর! ওকে একবার ছুঁলে আজীবন কোন প্রাচুর্য্যের প্রয়োজন পড়বে না!

মিনার্ভা মৃদু হেসে রাস্তার এপাড়ে চলে আসে। বলে, 'দেখলাম আপনাকে বহুদিন পর! জানেন, বিগত সময়গুলোতে আপনাকে নিয়ে একটা স্বপ্নই ঘুরেফিরে বারবার দেখেছি আমি! আমার ঘুমন্ত কপালে আপনার হাতের ছোঁয়া, সেই স্পর্শের রেশ ঘুম ভাঙ্গার পরও আগলে রেখেছে আমায় বহুদিন।' তারপর অকস্মাত দু হাত বাড়িয়ে ধরে নিল অনন্যর হাত, মুঠোভরে বলল 'এই ছিল আমার কাছে থেকে যাওয়া আপনার সময়। আপনার স্বপ্নের সাথে একেও মিলিয়ে নিয়েন। চলি।'

অনন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় দেখে নিল, মিনার্ভা মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। শ্রাবণের বৃষ্টি তখন নির্ভার আনন্দে ঝরছে!