বুধবার, ২০ মার্চ, ২০১৩

রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অদ্বিতীর শরীরের উত্তাপ বাড়ছে। ঘুম একদম নেই চোখে। কেবল আছে অবসন্নতা, বিষাদগ্রস্ততা। এমন কথা ছিল না। কথা ছিল, কাজ সেরে একসঙ্গে বাড়ি ফেরার। কিংবা এক; দুদিন এদিক সেদিক যদিও বা হয়, পাশে পেলে খুনসুটি করে সারাদিনের ক্লান্তি কাটিয়ে দেবার কথা ছিল। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুণগুণ গান করার কথা ছিল, চুলের গন্ধ নিতে নিতে, আদরের গন্ধে লেপ্টে দেবার কথা ছিল। অথচ সবটাই অধরা মনে হয়। কেন?

অপূর্ব আর অদ্বিতীর পরিচয়টা এমন করেই। ট্রেইনের কামড়ায় বহুদিনের পুরনো ভাল লাগার মানুষটিকে হঠাৎ আবিষ্কারের মত নয় বরং একেবারে অদেখা অদ্বিতীকে অপূর্ব কেমন আকুল করে কাছে টানতে লাগলো। যেন সে বহু আগেই আবিষ্কৃত ছিল তার!

অদ্বিতী তখন বড় একা, অসহায়। জীবন তাকে আরো একবার বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল তার পরম আকাংখিত, নির্ভরতার মানুষ থেকে। খুব ছোট কারণ মনে হবে আপাতদৃষ্টিতে, কিন্তু অদ্বিতী পারেনি মেনে নিতে। যাকে সে এতটা উজাড় করে দিয়েছিল বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যৎ সে তাকে বুঝলো না? তবু সে বোঝাতে চেয়েছিল, যা অভ্র ভাবছে তেমন কিচ্ছু নয়, অপমানে ঋজু হয়ে গেছিল অদ্বিতী, যখন তার মনে হল, তার জীবনের অদ্বিতীয় মানুষটিও পারল না বিশ্বাসের সুতোয় হাঁটতে! সেও ভেবে নিল সাধারণের মত, অদ্বিতীর মনে অন্য কারো বাস, সে ঠকাচ্ছে তাকে! পরিমিত বন্ধুত্ব  আর ভালবাসার মাঝেও সবার জন্য সম্মান অদ্বিতীর মনে, তা জেনেও অভ্র সন্দেহ করল অদ্বিতীকে!  অদ্বিতী তখন ভাবছিল অন্য কোন কিছু। সে ভাবছিল, অভ্রকে সে সাধারণে নামাতে পারবে কি করে? এর চাইতে আলাদা হয়ে যাওয়ায়ই বরং ভালবাসার মান বাঁচে ... অতঃপর মনে পরস্পরের জন্যে কথার ফুলঝুড়ি নিয়ে পরস্পরকে এড়িয়ে চলার সংকল্প। অভ্র আর অদ্বিতী আর কখনো মুখোমুখি হয়নি।

পৃথিবীর রঙ তখন তার কাছে ফিকে। অদ্বিতী জানত, হয়ত অভ্র পারবে একদিন বুঝতে তার ভুল। কিন্তু আত্মঅভিমান গলবে না তাদের কারোই কোনদিন। পৃথিবী এগিয়ে যায়। অদ্বিতী পড়ে থাকে একা। সে কথার মালা গাঁথে, খুঁটিনাটি গল্প করতে ইচ্ছে করে তার। কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে তার ইচ্ছে করে কেউ হাত বাড়িয়ে দিক, জিজ্ঞেস করুক পথে কোন সমস্যা হয়েছিল কিনা, কিংবা নুন, তেল, পেঁয়াজের সাবলীল গল্পই এক দুবার, নতুন কবিতার রস রুপ ছন্দ, আকাশ ফাটানো অট্টহাসির বান, খুব অল্পেতে সুখ খুঁজে ঘুমিয়ে পড়া। নতুন বইয়ের মলাটে উৎসর্গ করা তার নাম দেখতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে অকারণে অচেনা রাস্তায় সেই এক কাউকে পাশে নিয়ে হাঁটতে, পৃথিবীর আদি -অন্তের গল্প আর শুধু দুজনের গল্পে মশগুল হতে ইচ্ছে করে ... হয় না ... শুধু শূণ্যতা থাকে তার পাশে।

এমন জীবনেই অভ্যস্ত অদ্বিতী হাতছানি পায় অপূর্বের একদিন। অপূর্ব তাকে নতুন জীবনের স্বপ্ন বুনতে শেখায়। যে অদ্বিতী অচেনা মানুষ এড়িয়ে চলে, সেই কিনা বলে বসে একেবারেই অচেনা অপূর্বকে তার গোপন কষ্ট আর একাকীত্বের কথা। অদ্বিতী অবাক হয় মাঝে মাঝে। অপূর্ব কেন তাকে বৃষ্টির গল্প বলে, সংসার সাজানোর গল্প বলে, বউকে তার গোপন জীবন বলে ফেলার কথা বলে, ভালবাসার কথা বলে আর অদ্বিতীর নাম কেন বার বার লিখে দেয় খুব কঠিণ কোন আলোচনার মাঝে! ফেইসবুকে এক ঝলক দেখা অপূর্ব দু তিন দিনের কথোপকথনে অদ্বিতীর আমূল জেনে যায়! আর একদিন অবাক করে দিয়ে বলে বসে জীবনসঙ্গী হবার কথা! অন্ধ বিশ্বাস পুঁজি করে অদ্বিতী আরো একবার ভালবাসে। এতটাই ভালবাসে যে নিজেকেও ভুলে বসে!

খুব সুখে ভেসে যায় তারা। কিন্তু এবার ধাক্কা আসে ঝড়ের মত, মীমাংসিত সমঝোতায় মুখ ফেরানো নয়। বরং যেই অপূর্ব ভালবেসে কাছে টেনে নিয়েছিল, অদ্বিতী জানতে পারে, সে তার কাছে লুকিয়েছে তার নষ্ট অতীত। শুধু তাই নয়, অতীতের রেশ অদ্বিতীর আড়ালে জিইয়ে রেখেছে সে! অদ্বিতীর ভাগ সে করে নিয়েছে অন্য আরো অনেকের সাথে। অদ্বিতী বুঝতে পারে, এত নিটোল সম্পর্কেও অপূর্ব যখন তার সবটা লুকিয়ে আদ্বিতীকে বিয়ে করেছে আর সঙ্গে করে বয়ে বেড়াচ্ছে অতীতের নোংরা অভ্যাসের সঙ্গিনীদের, সেখানে তবে কি আর অবশিষ্ট আছে? ভালবাসা কোথাও নেই, বিশ্বাস নেই কোথাও কি? তবু বারবার অপূর্বকে প্রশ্ন করেছে সে, কারণ জানতে চেয়েছে। অপূর্ব তিরষ্কার করেছে, এড়িয়ে গেছে। অদ্বিতী শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর মিলাতে পারেনি। কেন অপূর্ব অদ্বিতীকে বেছে নিয়েছিল? কেন অনুভূতির সম্পর্ক গড়েছিল তবে? কেন স্বপ্ন দেখিয়েছিল? বারবার জানতে চেয়েছে একটাই কথা, মানুষ একই সঙ্গে কি করে পারে, বিশ্বাস অর্জন করে বিশ্বাসঘাতকতা করতে?! ... পায়নি, অপূর্ব বলেছে, ওসব তার ভুল ছিল, অদ্বিতী মানতে পারে না। ভুল সেটা তখন যখন সংশোধনের তাড়া থাকে, অনুশোচনা থাকে। কারো বিশ্বাসকে ঠকিয়ে অশ্লীলতা ভুল হতে পারে না কখনো।

কিন্তু অদ্বিতী পারে না। হেরে যায় ... কতবার কতভাবে অপূর্বকে সে ছেড়ে যেতে চায়, পারে না। আত্ম অভিমানও পা আটকে ধরে অদ্বিতীর। অপূর্বকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে পারে না অদ্বিতী। যতবার ভাবে দূরে যাবে, ততবার আরো অসহায় হয়ে পড়ে সে! সে বুঝতে পারে, অপূর্বকে ছেড়ে থাকতে সে পারবে না! নিজেকে ধিক্কার দেয়, কি করে এত দূর্বল হল সে! যেই অপূর্বের মুখের দিকে তাকালে অদ্বিতী সব কষ্ট ভুলে যায় সে তাকে এভাবে ছোট করেছে, এভাবে ঠকিয়েছে ভাবতে পারেনা সে। কি করে মানবে অদ্বিতী অপূর্বকে? অথচ গোটা পৃথিবীতে অদ্বিতীর ওই এক অপূর্বই আছে ভালবাসার।

সেই থেকে এক ছাদের নিচে তাদের ভিন্ন আবাস। আদ্বিতী জানে না, অপূর্ব এখনো তার পুরনো অভ্যাস জিইয়ে রেখেছে কিনা! কিন্তু তার জানতে ইচ্ছে করে, অপূর্ব তাকে ভালবাসে তা, তার ইচ্ছে করে অপূর্বকে নিয়ে আবার শুরু থেকে শুরু করতে, যেখানে অপূর্ব কিচ্ছু লুকাবেনা তার কাছে। অপূর্ব অদ্বিতীর কপালে চুমু এঁকে বলবে, তোমাকেই শুধু ভালবাসি ... এমনটা হয় না।

রাত দীর্ঘ হয়, সময় ছুটে চলে। এক ছাদের নিচে দুটো মানুষ দিনে দিনে দূরে সরে যায় ... এক ঘরে আলো জ্বলে, অন্য ঘরে অদ্বিতী জ্বরের ঘোরে ছটফট করে ওঠে, তার মনে হয়, অপূর্ব এসে ওর কপালে হাত ছোঁয়ালেই সব জ্বর দৌড়ে পালাবে, কিন্তু এমন হয় না। কারণ, অপূর্বের পরম আকাংখিত হাত যে মূহুর্তে অদ্বিতীর কপাল ছোঁবে, ভালবাসার অপমানে সে মূহুর্তেই মৃত্যু হবে অদ্বিতীর ...

অদ্বিতীর বিচ্ছিন্নভাবে কখনো অভ্রের কথা মনে পড়ে। কে আসলে ভুল ছিল, কে আসলে ঠিক?











কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন