শুক্রবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৮

যেন ছেঁড়া, শিশিরে ভিজে থাকা বিচ্ছিন্ন গোলাপি গোলাপ, 
সবুজ পাতায় জমানো রাত, ফুটেছে ঝরে যাবে তাই। 
গাঢ় রক্তের মত খয়েরি গোলাপ তাও ম্লান লাগে বড়। 
শুষ্ক ঠোঁট ভালোবাসি আমি
টুপ করে যেখানে লোনা জলের মত আবেগ জমিয়ে 
অপেক্ষায় থাকে প্রেমিক।
ভোরবেলা কোন পুকুরতলায় শ্যাওলা জমেছিল
যেন নগ্ন শরীর না হয় হিমায়িত, যেন উষ্ণতা
দখল করে নেয় আসন্ন দিনের সব কাজ!
অন্ধকার কেটে যাবার কালে হিজল বনে ঘুঘু ডাকে,
হুহু বেদনায় ভার হয় শরীর আবার।
ক্ষেতের আল বেয়ে ধেয়ে আসে গন্ধেরা,
পায়ে মাড়িয়ে আসা মাসকলাইয়ের কচি ঘ্রাণ। আহা!
তোমাকে কতদিন 'ভালোবাসি' বলা হয়নাই!
আনত চোখের ভাঁজে বিস্মরণ খেলা করে
দ্যাখো, দেখে দেখে দূরে সরে যাও
নয়ত কাঁপবে আবার শরীর,
আবার আঙ্গুল খেলতে চাইবে আঙ্গুলের সাথে মিটিমিটি।
অমন সাধের অভিমান এক জন্মের জন্য তোলা থাক।

(২৮।১২।২০১৮)

#গল্পগুলোনিরভানার 
একটা ছিল বন্ধুগলি। গলির মুখোমুখি দুই বারান্দাওয়ালা বাড়ি। একটা বাড়িতে থাকে কুকুর বন্ধু গুটু, আরেকটা বাড়িতে থাকে প্যান্ডা বন্ধু মোটু। একদিন শীতের সকালে খুব রোদ হেসে উঠল। তাই গুটুর ইচ্ছে হলো, সকালের হাঁটাটা সেরেই আসবে। উফফ, উফফ করতে করতে সে বেরোল পথে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল মোটু। মোটু বলল, 'বন্ধু, আমাকেও সাথে নাও!!' এরপর দুই বন্ধু হাত ধরে নাচতে নাচতে পৌঁছে গেলো পার্কে। ওদের সবচাইতে পছন্দের খেলা সি স আর স্লাইড! সি স তো একসাথে খেলল, বিপত্তি হলো স্লাইডে কে আগে উঠবে সেটা নিয়ে। লেগে গেলো লংকাকান্ড! শুরু হলো বৃষ্টি! দৌড়াতে দৌড়াতে ওরা টিলিয়া গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়াল। একেবারে কাকভেজা গুটু, মোটু হাঁচি দিতে লাগল! নিমেষেই ওরা দেখতে পেলো, বৃষ্টি গেছে থেমে। কিন্তু ততক্ষণে বারোটা বেজে গেছে ঘড়িতে। তখন তাদের দুপুরে খাবার সময়! মন খারাপ করে, গুটু মোটু আবার গলাগলি করে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।
গুটু বলল মোটুকে, 'ভালো থেকো বন্ধু, আবার দেখা হবে।'
মোটুও গুটুকে বলল, ভালো থেকো বন্ধু, আবার দেখা হবে।'
গুটু, মোটু একদমই ভুলে গেলো, স্লাইডে আগে পরে ওঠা নিয়ে ওরা যে ঝগড়া বাঁধিয়েছিল!

(ডিসেম্বার ৫, ২০১৮) 
বারান্দাটা খোলাই ছিল, 
খোলা হাওয়া সর্বস্ব নিয়ে দুলতে থাকলে-
বারান্দারা তার সঙ্গী হয়। 
কাঠের বাগান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শীতপীড়িত গাছ। 
তার পেছনে নির্জলা রোদ। 
হাত ভেজানো রোদের তাপে মনে হয়,
পায়ের নীচে খেলছে জলের ঢেউ
অথচ তারা দূর্দান্ত; ভেসেই চলেছে।

(০৮।১২।২০১৮) 
মা'র সঙ্গে আমার শেষবার যখন কথা হলো, মা তখন আমার এক ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে বাসায় ফিরেছে। অনেক রাত হয়ে গেছিলো। বাবা-মা রাতে বাসায় ফিরে ক্লান্ত ছিল। আমি দিনের যে সময়টায় একটু সময় করতে পারতাম অথবা সাধারণত বিকেলের দিকে কল করতাম। মা তখন সব কাজ গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় আমাদের ফোনের অপেক্ষায়। ওই সময়টায় মা আর কোনকিচ্ছু করত না, বাবা বলে। রাফিদ নরওয়ে থেকে, আমি এখান থেকে, মা বাবা ঢাকায়। সবাই একসাথে কনফারেন্স কলে, যেন নিজেদের এক বিছানায় চাপাচাপি করে শুয়ে থেকে গল্পের আমেজটা চাইতাম। হতো না ঠিক। তবু আমরা ছিলাম একসঙ্গে। আমরাই বরং মা'র সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না, সারাক্ষণ ব্যস্ততা ... যেন শুধু মায়েরই কোন ব্যস্ততা নেই! অথচ আমার মা যে কত ব্যস্ত থাকত ... পাঁচ বছরের গ্যাপে ভুলে যাচ্ছিলাম, ঢাকা শহরে ঘর, বাইরে সামলানো যে কোন মানুষই সুপার পাওয়ারফুল। শুধুমাত্র মনের জোরে এরা একেকটা দিন পাড়ি দেন। আমিও দেই, আমরাও দেই, কিন্তু এসব দেশে নাগরিক সুবিধা সহজলভ্য মানে যেটা অধিকার সেটা যে আদায় করতে হয় এমন চিন্তা মাথায় আসার অপেক্ষায় না থেকে ওটা বরং অন্য কোন ছুটে লাগানো যায়। আমার মা এতোকিছু সামলেও যখন আমার সময় অনুযায়ী আমি কল করতাম, আমার জন্য হাজির হতো। আমি রেখে দিতে চাইলেও মা থামতে চাইত না, কতো বকা দিয়েছি মা'কে ... এতো আপন মানুষ, তাকেই শুধু ওভাবে বলা যায়, সে-ই তবু জানপ্রাণ বাজি রেখে দোয়া দিতো। যার মা নেই, সে বুঝবে কেন এসব বলছি। অথবা বুঝবে না। এতো মানুষ দেখি, মা'র মতন মানুষ তো পাইনা! অমন করে কথা বলা, অমন করে আদর করা, অমন নিঃস্বার্থ, অমন স্বকীয়তা, অমন সুন্দর পরিচ্ছন্ন ভাবনার, দেখতে! আমার মা'টা কোথায় যে চলে গেলো! বরাবরের মতোই হাসপাতালে ভর্তি শুনে নিশ্চিতভাবে জানতাম, মা সুস্থ্য হয়ে বাসায় আসবে। আর কথা হলো না। সেইরাতে মা কথা বলতে পারেনি। আমি ভেবেছিলাম, মা'র খুব ঘুম পাচ্ছে। মনে খচখচ করছিল, মা তো ঘুমন্ত অবস্থায়ও জেগে থাকতে চায়, আমি কল করলে। মা ঘুমাতে চাইলো কেন? শেষ কথা ছিল, 'মা, আমি ঘুমাই।' বিয়েবাড়ি যাওয়ার আগে রাফিদের জন্য নরওয়েতে রান্না করে কতকিছু পাঠিয়েেছে! ভেতরে ভেতরে মারাত্মক অসুস্থ মানুষটা, কেউ জানেনি, বোঝেনি, খেয়াল করতে পারেনি। ডাক্তাররাও না! আমি কোনদিন কাউকে জোর করিনা, ইচ্ছে থাকলেও সংবরন করি। আমার খুব ইচ্ছে করল, মা'কে জাগতে বলি, আরেকটু কথা বলি। কিন্তু মা'কে বললাম, 'আচ্ছা মা, কাল কথা হবে।' এই কাল কথা বলতে চাওয়ার মাঝে কিরকম টেনশন কাজ করে, বাইরে থাকা ছেলেমেয়েরা শুধু বুঝবে। এই বুঝি পাব না, এই বুঝি খারাপ খবর আসে আশংকায় আমরা ফোন রেখে দিই ... সেই খবর এলো! আমার চোখের সামনে মা ঘুমাচ্ছিল, পরম মমতায় মা'কে ঘুমাতে দেখলাম। মা জেনেছে কিনা, আমার ভাবনাগুলোকে! হাসপাতালের বিছানায় যখন শুয়েছিল, প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল তার, তবু আমি দেখতে চাচ্ছি জেনে জোর করে চোখ মেলে তাকিয়েছিল, আমি তখনও বুঝতে পারিনি, মাকে চোখ খোলা অবস্থায় আর দেখব না কোনদিন! আমার মা চলে গেছে ... আজ চারমাস। আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিচ্ছে, প্রচন্ড শাস্তি। প্রচন্ড কষ্ট। আর কোনদিন মা'র হাত ধরতে পারব না, তার গান শুনব না, তার চুলের গন্ধ নিব না, তার হাতের রান্না খাব না, মা অভিমান করেও ফিরবে না। সেদিন অনেক রাতে ছেলেমানুষী করে আকাশেও তাকালাম। রাতের আকাশে নাকি মানুষ তারা হয়ে যায় ... অসহায় নিজেকে সামলাতে সামলাতে ভাবছিলাম, মায়ের প্রয়োজন তো ফুরায়নি, চোখ নিজে নিজে মুছতে পারার সক্ষমতা এসে গেলেই মা'কে নিয়ে যেতে হয়? মা-গো, ভালো থাকো তুমি ... (11.12.2018)