মা'র সঙ্গে আমার শেষবার যখন কথা হলো, মা তখন আমার এক ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে বাসায় ফিরেছে। অনেক রাত হয়ে গেছিলো। বাবা-মা রাতে বাসায় ফিরে ক্লান্ত ছিল। আমি দিনের যে সময়টায় একটু সময় করতে পারতাম অথবা সাধারণত বিকেলের দিকে কল করতাম। মা তখন সব কাজ গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় আমাদের ফোনের অপেক্ষায়। ওই সময়টায় মা আর কোনকিচ্ছু করত না, বাবা বলে। রাফিদ নরওয়ে থেকে, আমি এখান থেকে, মা বাবা ঢাকায়। সবাই একসাথে কনফারেন্স কলে, যেন নিজেদের এক বিছানায় চাপাচাপি করে শুয়ে থেকে গল্পের আমেজটা চাইতাম। হতো না ঠিক। তবু আমরা ছিলাম একসঙ্গে। আমরাই বরং মা'র সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না, সারাক্ষণ ব্যস্ততা ... যেন শুধু মায়েরই কোন ব্যস্ততা নেই! অথচ আমার মা যে কত ব্যস্ত থাকত ... পাঁচ বছরের গ্যাপে ভুলে যাচ্ছিলাম, ঢাকা শহরে ঘর, বাইরে সামলানো যে কোন মানুষই সুপার পাওয়ারফুল। শুধুমাত্র মনের জোরে এরা একেকটা দিন পাড়ি দেন। আমিও দেই, আমরাও দেই, কিন্তু এসব দেশে নাগরিক সুবিধা সহজলভ্য মানে যেটা অধিকার সেটা যে আদায় করতে হয় এমন চিন্তা মাথায় আসার অপেক্ষায় না থেকে ওটা বরং অন্য কোন ছুটে লাগানো যায়। আমার মা এতোকিছু সামলেও যখন আমার সময় অনুযায়ী আমি কল করতাম, আমার জন্য হাজির হতো। আমি রেখে দিতে চাইলেও মা থামতে চাইত না, কতো বকা দিয়েছি মা'কে ... এতো আপন মানুষ, তাকেই শুধু ওভাবে বলা যায়, সে-ই তবু জানপ্রাণ বাজি রেখে দোয়া দিতো। যার মা নেই, সে বুঝবে কেন এসব বলছি। অথবা বুঝবে না। এতো মানুষ দেখি, মা'র মতন মানুষ তো পাইনা! অমন করে কথা বলা, অমন করে আদর করা, অমন নিঃস্বার্থ, অমন স্বকীয়তা, অমন সুন্দর পরিচ্ছন্ন ভাবনার, দেখতে! আমার মা'টা কোথায় যে চলে গেলো! বরাবরের মতোই হাসপাতালে ভর্তি শুনে নিশ্চিতভাবে জানতাম, মা সুস্থ্য হয়ে বাসায় আসবে। আর কথা হলো না। সেইরাতে মা কথা বলতে পারেনি। আমি ভেবেছিলাম, মা'র খুব ঘুম পাচ্ছে। মনে খচখচ করছিল, মা তো ঘুমন্ত অবস্থায়ও জেগে থাকতে চায়, আমি কল করলে। মা ঘুমাতে চাইলো কেন? শেষ কথা ছিল, 'মা, আমি ঘুমাই।' বিয়েবাড়ি যাওয়ার আগে রাফিদের জন্য নরওয়েতে রান্না করে কতকিছু পাঠিয়েেছে! ভেতরে ভেতরে মারাত্মক অসুস্থ মানুষটা, কেউ জানেনি, বোঝেনি, খেয়াল করতে পারেনি। ডাক্তাররাও না! আমি কোনদিন কাউকে জোর করিনা, ইচ্ছে থাকলেও সংবরন করি। আমার খুব ইচ্ছে করল, মা'কে জাগতে বলি, আরেকটু কথা বলি। কিন্তু মা'কে বললাম, 'আচ্ছা মা, কাল কথা হবে।' এই কাল কথা বলতে চাওয়ার মাঝে কিরকম টেনশন কাজ করে, বাইরে থাকা ছেলেমেয়েরা শুধু বুঝবে। এই বুঝি পাব না, এই বুঝি খারাপ খবর আসে আশংকায় আমরা ফোন রেখে দিই ... সেই খবর এলো! আমার চোখের সামনে মা ঘুমাচ্ছিল, পরম মমতায় মা'কে ঘুমাতে দেখলাম। মা জেনেছে কিনা, আমার ভাবনাগুলোকে! হাসপাতালের বিছানায় যখন শুয়েছিল, প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল তার, তবু আমি দেখতে চাচ্ছি জেনে জোর করে চোখ মেলে তাকিয়েছিল, আমি তখনও বুঝতে পারিনি, মাকে চোখ খোলা অবস্থায় আর দেখব না কোনদিন! আমার মা চলে গেছে ... আজ চারমাস। আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিচ্ছে, প্রচন্ড শাস্তি। প্রচন্ড কষ্ট। আর কোনদিন মা'র হাত ধরতে পারব না, তার গান শুনব না, তার চুলের গন্ধ নিব না, তার হাতের রান্না খাব না, মা অভিমান করেও ফিরবে না। সেদিন অনেক রাতে ছেলেমানুষী করে আকাশেও তাকালাম। রাতের আকাশে নাকি মানুষ তারা হয়ে যায় ... অসহায় নিজেকে সামলাতে সামলাতে ভাবছিলাম, মায়ের প্রয়োজন তো ফুরায়নি, চোখ নিজে নিজে মুছতে পারার সক্ষমতা এসে গেলেই মা'কে নিয়ে যেতে হয়? মা-গো, ভালো থাকো তুমি ... (11.12.2018)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন