শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

ভালোবাসা, এই দেশে কাঠগোলাপ নাই. নাই কৃষ্ণচূড়াও! দোলনচাঁপা, পানাফুল! পানকৌড়ি, প্রজাপতির মতো চঞ্চল ছুটে এসে বাড়ির পুকুরে হুট করে বসে. ডাহুকের ডাক শুনে ভর দুপুরবেলায় প্রাণ শুকায়, কিসের যে সে শূন্যতা! 
ভালোবাসা, কেবল তোমার নাম ধরে ডাকা ছাড়া ভিন্ন কোনো কিছুই মনে পড়ছে না. বাড়ির পুকুরঘাটে কত দুপুর একা বসে ভেবেছি এলেবেলে, বৃষ্টি নেমেছে. আমাকে অবাক করে, ভেলায় ভেসে দিব্যি রপ্ত করে নিতে দেখেছি সাঁতার. 
তুমি কী ঘুঘুর ডাক শুনে থমকে দাঁড়িয়েছ কখনও, ভালোবাসা? প্রথম ভোরে অশরীরীর সাদা শাড়ির মতো কোমল পাখার কোনো ঘুঘু, তোমার ব্যস্ততাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেনি কোনোদিন? 
ভালোবাসা, আমার একান্ত পুকুরঘাটটা ছিল কুয়োর ধারে. টলমলে জলে মাঝে মাঝে হাওয়ার ঢেউ দুলে উঠত. অনবরত তাদের ম্রিয়মান হতে দেখে আমি জেনেছিলাম, পৃথিবীতে সব এলোমেলো. খুব করে চাওয়া মাটির পুতুলও হারিয়ে যায়. 
একদিন তুমিও হারাবে
কাশফুল ছুঁয়ে থাকা মেয়ে
ডাঙায় দাঁড়ালে মেঘ মেঘ শরৎ
নীল গায়ে তাঁত বুনে দিবো 
সাথে কিছু চোরকাঁটা পায় 
রিমঝিম মচমচে দুপুরের রোদে 
ওম নিতে নিতে কিছু ঘুম
তারপর একছুটে পানাফুল পাঁপড়িতে
খুঁজে নিস অবিকল ময়ূর যুবক.

শুক্রবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৮

যেন ছেঁড়া, শিশিরে ভিজে থাকা বিচ্ছিন্ন গোলাপি গোলাপ, 
সবুজ পাতায় জমানো রাত, ফুটেছে ঝরে যাবে তাই। 
গাঢ় রক্তের মত খয়েরি গোলাপ তাও ম্লান লাগে বড়। 
শুষ্ক ঠোঁট ভালোবাসি আমি
টুপ করে যেখানে লোনা জলের মত আবেগ জমিয়ে 
অপেক্ষায় থাকে প্রেমিক।
ভোরবেলা কোন পুকুরতলায় শ্যাওলা জমেছিল
যেন নগ্ন শরীর না হয় হিমায়িত, যেন উষ্ণতা
দখল করে নেয় আসন্ন দিনের সব কাজ!
অন্ধকার কেটে যাবার কালে হিজল বনে ঘুঘু ডাকে,
হুহু বেদনায় ভার হয় শরীর আবার।
ক্ষেতের আল বেয়ে ধেয়ে আসে গন্ধেরা,
পায়ে মাড়িয়ে আসা মাসকলাইয়ের কচি ঘ্রাণ। আহা!
তোমাকে কতদিন 'ভালোবাসি' বলা হয়নাই!
আনত চোখের ভাঁজে বিস্মরণ খেলা করে
দ্যাখো, দেখে দেখে দূরে সরে যাও
নয়ত কাঁপবে আবার শরীর,
আবার আঙ্গুল খেলতে চাইবে আঙ্গুলের সাথে মিটিমিটি।
অমন সাধের অভিমান এক জন্মের জন্য তোলা থাক।

(২৮।১২।২০১৮)

#গল্পগুলোনিরভানার 
একটা ছিল বন্ধুগলি। গলির মুখোমুখি দুই বারান্দাওয়ালা বাড়ি। একটা বাড়িতে থাকে কুকুর বন্ধু গুটু, আরেকটা বাড়িতে থাকে প্যান্ডা বন্ধু মোটু। একদিন শীতের সকালে খুব রোদ হেসে উঠল। তাই গুটুর ইচ্ছে হলো, সকালের হাঁটাটা সেরেই আসবে। উফফ, উফফ করতে করতে সে বেরোল পথে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল মোটু। মোটু বলল, 'বন্ধু, আমাকেও সাথে নাও!!' এরপর দুই বন্ধু হাত ধরে নাচতে নাচতে পৌঁছে গেলো পার্কে। ওদের সবচাইতে পছন্দের খেলা সি স আর স্লাইড! সি স তো একসাথে খেলল, বিপত্তি হলো স্লাইডে কে আগে উঠবে সেটা নিয়ে। লেগে গেলো লংকাকান্ড! শুরু হলো বৃষ্টি! দৌড়াতে দৌড়াতে ওরা টিলিয়া গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়াল। একেবারে কাকভেজা গুটু, মোটু হাঁচি দিতে লাগল! নিমেষেই ওরা দেখতে পেলো, বৃষ্টি গেছে থেমে। কিন্তু ততক্ষণে বারোটা বেজে গেছে ঘড়িতে। তখন তাদের দুপুরে খাবার সময়! মন খারাপ করে, গুটু মোটু আবার গলাগলি করে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।
গুটু বলল মোটুকে, 'ভালো থেকো বন্ধু, আবার দেখা হবে।'
মোটুও গুটুকে বলল, ভালো থেকো বন্ধু, আবার দেখা হবে।'
গুটু, মোটু একদমই ভুলে গেলো, স্লাইডে আগে পরে ওঠা নিয়ে ওরা যে ঝগড়া বাঁধিয়েছিল!

(ডিসেম্বার ৫, ২০১৮) 
বারান্দাটা খোলাই ছিল, 
খোলা হাওয়া সর্বস্ব নিয়ে দুলতে থাকলে-
বারান্দারা তার সঙ্গী হয়। 
কাঠের বাগান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শীতপীড়িত গাছ। 
তার পেছনে নির্জলা রোদ। 
হাত ভেজানো রোদের তাপে মনে হয়,
পায়ের নীচে খেলছে জলের ঢেউ
অথচ তারা দূর্দান্ত; ভেসেই চলেছে।

(০৮।১২।২০১৮) 
মা'র সঙ্গে আমার শেষবার যখন কথা হলো, মা তখন আমার এক ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে বাসায় ফিরেছে। অনেক রাত হয়ে গেছিলো। বাবা-মা রাতে বাসায় ফিরে ক্লান্ত ছিল। আমি দিনের যে সময়টায় একটু সময় করতে পারতাম অথবা সাধারণত বিকেলের দিকে কল করতাম। মা তখন সব কাজ গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় আমাদের ফোনের অপেক্ষায়। ওই সময়টায় মা আর কোনকিচ্ছু করত না, বাবা বলে। রাফিদ নরওয়ে থেকে, আমি এখান থেকে, মা বাবা ঢাকায়। সবাই একসাথে কনফারেন্স কলে, যেন নিজেদের এক বিছানায় চাপাচাপি করে শুয়ে থেকে গল্পের আমেজটা চাইতাম। হতো না ঠিক। তবু আমরা ছিলাম একসঙ্গে। আমরাই বরং মা'র সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না, সারাক্ষণ ব্যস্ততা ... যেন শুধু মায়েরই কোন ব্যস্ততা নেই! অথচ আমার মা যে কত ব্যস্ত থাকত ... পাঁচ বছরের গ্যাপে ভুলে যাচ্ছিলাম, ঢাকা শহরে ঘর, বাইরে সামলানো যে কোন মানুষই সুপার পাওয়ারফুল। শুধুমাত্র মনের জোরে এরা একেকটা দিন পাড়ি দেন। আমিও দেই, আমরাও দেই, কিন্তু এসব দেশে নাগরিক সুবিধা সহজলভ্য মানে যেটা অধিকার সেটা যে আদায় করতে হয় এমন চিন্তা মাথায় আসার অপেক্ষায় না থেকে ওটা বরং অন্য কোন ছুটে লাগানো যায়। আমার মা এতোকিছু সামলেও যখন আমার সময় অনুযায়ী আমি কল করতাম, আমার জন্য হাজির হতো। আমি রেখে দিতে চাইলেও মা থামতে চাইত না, কতো বকা দিয়েছি মা'কে ... এতো আপন মানুষ, তাকেই শুধু ওভাবে বলা যায়, সে-ই তবু জানপ্রাণ বাজি রেখে দোয়া দিতো। যার মা নেই, সে বুঝবে কেন এসব বলছি। অথবা বুঝবে না। এতো মানুষ দেখি, মা'র মতন মানুষ তো পাইনা! অমন করে কথা বলা, অমন করে আদর করা, অমন নিঃস্বার্থ, অমন স্বকীয়তা, অমন সুন্দর পরিচ্ছন্ন ভাবনার, দেখতে! আমার মা'টা কোথায় যে চলে গেলো! বরাবরের মতোই হাসপাতালে ভর্তি শুনে নিশ্চিতভাবে জানতাম, মা সুস্থ্য হয়ে বাসায় আসবে। আর কথা হলো না। সেইরাতে মা কথা বলতে পারেনি। আমি ভেবেছিলাম, মা'র খুব ঘুম পাচ্ছে। মনে খচখচ করছিল, মা তো ঘুমন্ত অবস্থায়ও জেগে থাকতে চায়, আমি কল করলে। মা ঘুমাতে চাইলো কেন? শেষ কথা ছিল, 'মা, আমি ঘুমাই।' বিয়েবাড়ি যাওয়ার আগে রাফিদের জন্য নরওয়েতে রান্না করে কতকিছু পাঠিয়েেছে! ভেতরে ভেতরে মারাত্মক অসুস্থ মানুষটা, কেউ জানেনি, বোঝেনি, খেয়াল করতে পারেনি। ডাক্তাররাও না! আমি কোনদিন কাউকে জোর করিনা, ইচ্ছে থাকলেও সংবরন করি। আমার খুব ইচ্ছে করল, মা'কে জাগতে বলি, আরেকটু কথা বলি। কিন্তু মা'কে বললাম, 'আচ্ছা মা, কাল কথা হবে।' এই কাল কথা বলতে চাওয়ার মাঝে কিরকম টেনশন কাজ করে, বাইরে থাকা ছেলেমেয়েরা শুধু বুঝবে। এই বুঝি পাব না, এই বুঝি খারাপ খবর আসে আশংকায় আমরা ফোন রেখে দিই ... সেই খবর এলো! আমার চোখের সামনে মা ঘুমাচ্ছিল, পরম মমতায় মা'কে ঘুমাতে দেখলাম। মা জেনেছে কিনা, আমার ভাবনাগুলোকে! হাসপাতালের বিছানায় যখন শুয়েছিল, প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল তার, তবু আমি দেখতে চাচ্ছি জেনে জোর করে চোখ মেলে তাকিয়েছিল, আমি তখনও বুঝতে পারিনি, মাকে চোখ খোলা অবস্থায় আর দেখব না কোনদিন! আমার মা চলে গেছে ... আজ চারমাস। আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিচ্ছে, প্রচন্ড শাস্তি। প্রচন্ড কষ্ট। আর কোনদিন মা'র হাত ধরতে পারব না, তার গান শুনব না, তার চুলের গন্ধ নিব না, তার হাতের রান্না খাব না, মা অভিমান করেও ফিরবে না। সেদিন অনেক রাতে ছেলেমানুষী করে আকাশেও তাকালাম। রাতের আকাশে নাকি মানুষ তারা হয়ে যায় ... অসহায় নিজেকে সামলাতে সামলাতে ভাবছিলাম, মায়ের প্রয়োজন তো ফুরায়নি, চোখ নিজে নিজে মুছতে পারার সক্ষমতা এসে গেলেই মা'কে নিয়ে যেতে হয়? মা-গো, ভালো থাকো তুমি ... (11.12.2018)

শুক্রবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৮

গল্পগুলো নিরভানা'র।
সে অনেকদিন আগের কথা। শহরের শেষভাগে ছিল একটা বন। ঘন জঙ্গল আর গাছপালার আড়ালে, বনে ছোট্ট কুঁড়েঘর। সেই কুঁড়েঘরে বাস করত ধবধবে সাদা চুলের এক বুড়িমা। বুড়িমা রাতে চোখে দেখতে পেতো না। তাই সে দিনের বেলায়ই বনে ঘুরে ঘুরে তার খাবার সংগ্রহ করে রাখত। সন্ধ্যার আগেভাগে বন থেকে গাছের শুকনো ডাল, পাতা খুঁজে এনে চুলায় আগুন জ্বালিয়ে সেসব রান্না করে একাই খেত। তার না ছিল কোন সন্তান, না ছিল নাতিপুতি। এভাবেই কাটছিল তার দিন। বুড়িমার প্রতি সপ্তাহের রুটিন এই একটাই। শুক্রবার, শনিবার, রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার, বৃহস্পতিবার আবার সেই শুক্রবার থেকে বৃহস্পতিবার। এমনি করে শহরে ভীষণ শীত পড়ল। কেউ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরোয় না। বিকেল চারটায়ই টুপ করে সূর্য ডোবে। শহরের মানুষেরা সবাই ঘুমিয়ে যায় আটটা বাজতেই। না থাকে কোন দোকান খোলা, না চলে কোন যানবাহন। বনের প্রাণীগুলোও সব ঠান্ডা সামলাতে যার যার গর্তে চলে যায়। এদিকে বুড়িমাও প্রতি সকালে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে কিছু না পেয়ে ভুখা পেটে ঘুমোতে থাকে। এমন করে করে সে অসুস্থ্য হয়ে যেতে শুরু করে। রাতের আঁধারে ক্ষুধার যন্ত্রণায় বুড়িমা কাঁদতে থাকে আর বলে, 'আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে, আমাকে কিছু খেতে দাও!' ... ঝোপঝাড়ের আড়াল বেয়ে, শুকনো, খটমটে গাছগুলো ভেদ করে শহরের কারো কানে সেই কান্নার শব্দ পোঁছায় না।
দিনে দিনে ওদিকে শীত বেড়েই চলেছে। বরফ ঝড়ে ভেঙ্গে পড়েছে গাছের ডাল।
এক শহরের সঙ্গে আরেক শহরের যোগাযোগবিচ্ছিন্নতা। এমনই এক রাতে বুড়িমা ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে না পেরে লাঠিতে ভর করেই ছুটল বনের বাইরে। রাতের বেলায় বুড়িমা তো কিছুই দেখে না চোখে, তবু দীর্ঘদিনের চেনা বনের পথ আন্দাজ করে করে সাবধানেই এগোতে লাগল সে।
বনের পথ শেষ হলেই প্রধান সড়ক। সড়কের অপর প্রান্তে বুড়িমা একটা বাড়ির জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলতে লাগল, 'ভেতরে কেউ আছো? আমাকে কিছু খেতে দাও, ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।' কোন সাড়া নেই। বুড়িমা আস্তে আস্তে টোকা দিল জানালায়। তবু কেউ কোন শব্দ করল না। বুড়িমা এতোটা পথ হেঁটে আরো দূর্বল হয়ে গেছে। নিস্তেজ হয়ে সে জানালার পাশেই বসে পড়ল।
বুড়িমা যেই বাড়ির জানালায় টোকা দিচ্ছিল, সেটা ছিল আসলে অন্তুদের বাসা। অন্তু আবার রাতে ঘুমোত না। তাই সে রাতের বেলায় নানাকিছু নিয়ে খেলত, বই পড়ত। সেই রাতে অন্তু ফায়ার প্লেইসের আলোয় দেয়ালে নিজের হাতের ছায়ায় নানাকিছু বানাচ্ছিল। হঠাত জানালায় টোকা শুনতে পেয়ে তার কিছুটা ভয় লেগে গেলো। তারপর কি যেন ভেবে সে জানালা খুলে ডান বাম তাকাল। হু হু করে ঘরের ভেতর শীতের বাতাস ঢুকে যাচ্ছিল, নিমিষেই অন্তুর নাক লাল হয়ে গেলো। অন্তু জানালা বন্ধ করবে তখনই তার চোখ পড়ল জানালার নিচে, সেখানে সে দেখতে পেলো বুড়িমা বসে আছে। অন্তু গলার স্বর নামিয়ে প্রশ্ন করল, 'জানালার পাশে বসে আছো, কে তুমি?'
কোন উত্তর পেলো না। অন্তুর কেমন ভয় লাগল। সে আবার জানতে চাইল, 'তুমি কে?' তবু কোন সাড়াশব্দ নেই।
গলার স্বর আরেকধাপ বাড়িয়ে অন্তু তড়িঘড়ি জানতে চাইল, 'কে তুমি?' এই না বলে অন্তু যেই না জানালা বন্ধ করতে যাচ্ছিল, বুড়িমা খপ করে অন্তুর হাত ধরে ফেলল। আর বলল, 'এক্ষুণি আমাকে কিছু খেতে দাও, মুরগির ঝোল দাও, আমি ভাত খাব।'
অন্তু ভয় পেয়ে হাত হ্যাঁচকা টানে যেই না সরাবে, বুড়িমা উঠে দাঁড়িয়ে অন্তুকে ফিসফিসিয়ে বলল, 'হয় আমাকে মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত দাও, নয়ত তুমি আমার খাবার হও।' ভীষণ ভীতসন্ত্রস্ত অন্তুর তখন পড়ি কি মরি অবস্থা। সে বলল, 'আমার হাত ছেড়ে দাও বুড়িমা। তুমি যা চাও, তাই হবে।'
বুড়িমা তখন বলল, 'তবে তাই হোক। আজ থেকে রোজ সন্ধ্যায় তুমি আমাকে মুরগির ঝোল আর সাদা ভাতের যোগান দেবে, নয়ত তুমি আমার খাবার হবে।'
অন্তু ভয় পেয়ে কিচ্ছুটি না ভেবে রাজি হয়ে গেলো।
এভাবেই অন্তুদের বাসার মুরগির খামার থেকে প্রতিদিন মুরগি গায়েব হতে লাগল। সপ্তাহ শেষে খামারে তখন মুরগি আছে আর মোটে তিনটা। অন্তুর মা মুরগির স্যুপ করবে, কিন্তু গিয়ে দেখে তার মুরগি উধাও! রাতেই সে অন্তুর বাবাকে সব ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে অন্তুর বাবাও তো মহা চিন্তিত। পরদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা বাসার ছাদে উঠে, গরম কাপড় গায়ে চাপিয়ে অন্তুর বাবা বসে রইল, ঘটনার পেছনের রহস্য অনুসন্ধানে। সন্ধ্যার আঁধারে সে যা দেখতে পেলো, তাতে তো তার আক্কেল গুড়ুম হবার যোগাড়! সে দেখলো, খামার থেকে মুরগি নিয়ে বনের দিকে ছুটে যাচ্ছে অন্তু! অন্তুর বাবার তো মাথায় কিছুই খেলছে না। তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতরে গিয়ে সে বসল অন্তুর মায়ের সঙ্গে পরামর্শে। সব শুনে মা বলল, অন্তুর সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হবে। কিন্তু এমনভাবে কথা বলতে হবে যেন অন্তুর মনে হয়, বাবা মা এ বিষয়ে কিছুই জানেনা।
পরদিন সকালে অন্তু স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মা পৌঁছাল তার ঘরে। বলল, 'অন্তু, আজ আমরা বনের পথ ধরে স্কুলে যাব। তোমারও ভালো লাগবে। কিন্তু অন্তু তো কিছুতেই রাজি না সেই পথে যেতে। মা বলল, 'চলোই না, আমরা দু'জন বনের পথে কনকার্স জমাব।' অগত্যা অন্তুর যেতেই হলো। মা'র তো ভেতরে ছিল উদ্বেগ। অন্তু কেন বনের ভেতরে রাত বিরাতে মুরগি নিয়ে একা একা ছোটে, সেটা খুঁজে বের করা। মা আর অন্তু বনের ভেতরে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, ওদিকে অন্তুরও দমবন্ধ হয়ে আসছে, মা বুঝি সব টের পেয়ে গেলো! বুড়িমার কুঁড়েঘর থেকে অন্তু আর দশ কদম দূরে। ঠিক তখনই অন্তু গলা ঝেড়ে কাশল। বলল, 'মা, থামো, তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।'
মা-ও ভেতরে ভেতরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিন্তু মুখে যতোটা সম্ভব হাসি ধরে রেখে জানতে চাইল, 'কি বলবে অন্তু?'
অন্তু তখন সেইরাতে বুড়িমার দেওয়া শর্ত থেকে শুরু করে কেমন করে বুড়িমার সঙ্গে তার পরিচয় সব খুলে বলল মাকে। মায়ের তো তখন ছোট্ট অন্তুবাবুর জন্য দারুণ আদর জমেছে বুকে! মা বলল, 'তুমি কেন আগে আমাদের খুলে বলোনি অন্তু? বুড়িমা তোমাকে যে শর্ত দিয়েছে সেতো ক্ষুধার যন্ত্রণায়। কিন্তু তুমি ভয় পেয়ে মা বাবাকেই কিছু বলোনি। একা একা সব সামলে নিতে গিয়ে কেমন বিপদে পড়ে গেছো দেখেছ?'
অন্তু দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলে বলল, 'উফ মা, আমি তো ভেবেছি, তোমরা আমার কথাই শুনবে না, কিছু বিশ্বাসই করবে না! ধন্যবাদ মা, আমার কথা শোনার জন্য।'
মা বলল, 'আমার লক্ষীসোনা, তোমার কথা কেন শুনব না? কেন বুঝব না? মা-বাবার সাথে কিছু লুকিও না আর, কেমন? যদি তুমি এর চাইতেও বড় কোন বিপদে পড়তে, তখন কেমন হতো?'
মা এরপর অন্তুকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িমার কুঁড়েঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। বুড়িমা তখন নিজের সাদা চুলগুলো আঁচড়াচ্ছে। মা বলল, 'বুড়িমা, আসব?'
বুড়িমা তো আবাক! জানতে চাইল, 'কে তুমি?' মা বলল, 'আমি অন্তুর মা। তোমাকে আমরা আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে এসেছি, তুমি আমাদের সঙ্গে বাড়ি যাবে?'
এই আকস্মিক প্রস্তাবে বুড়িমার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল পানি। বুড়িমা বলল, 'দাঁড়াও মা, চুল বেঁধে নিই!'
এভাবেই অন্তু, অন্তুর মা বুড়িমাকে সঙ্গে করে ফিরল বাড়ি। ওদিকে অন্তুরও শীতকালীন ছুটি শুরু হলো। স্কুল ছুটির দিনগুলোতে অন্তু প্রতি রাতে বুড়িমার পাশে বসে মজার মজার সব গল্প শুনে রাতে ঘুমোতে শুরু করল। যেই অন্তুর ঘুম আসত না, সে এখন নিয়ম করে গল্প শোনে, নিয়ম করে ঘুমোয়। অন্তুর মা দু'জনের জন্য মুরগির স্যুপ করে দেয়, দু'জনে মহা আনন্দে সেটা খায়। অন্তু ঘুমিয়ে গেলে অন্তুর বাবা পা টিপেটিপে এসে ফায়ার প্লেইসের আলো কমায়।
বনের সেই কুঁড়েঘরটায় এখন আর কেউ থাকে না। শুনেছি, সেখানে এখন কাঠবিড়ালী ঘর পেতেছে।