গল্পগুলো নিরভানা'র।
সে অনেকদিন আগের কথা। শহরের শেষভাগে ছিল একটা বন। ঘন জঙ্গল আর গাছপালার আড়ালে, বনে ছোট্ট কুঁড়েঘর। সেই কুঁড়েঘরে বাস করত ধবধবে সাদা চুলের এক বুড়িমা। বুড়িমা রাতে চোখে দেখতে পেতো না। তাই সে দিনের বেলায়ই বনে ঘুরে ঘুরে তার খাবার সংগ্রহ করে রাখত। সন্ধ্যার আগেভাগে বন থেকে গাছের শুকনো ডাল, পাতা খুঁজে এনে চুলায় আগুন জ্বালিয়ে সেসব রান্না করে একাই খেত। তার না ছিল কোন সন্তান, না ছিল নাতিপুতি। এভাবেই কাটছিল তার দিন। বুড়িমার প্রতি সপ্তাহের রুটিন এই একটাই। শুক্রবার, শনিবার, রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার, বৃহস্পতিবার আবার সেই শুক্রবার থেকে বৃহস্পতিবার। এমনি করে শহরে ভীষণ শীত পড়ল। কেউ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরোয় না। বিকেল চারটায়ই টুপ করে সূর্য ডোবে। শহরের মানুষেরা সবাই ঘুমিয়ে যায় আটটা বাজতেই। না থাকে কোন দোকান খোলা, না চলে কোন যানবাহন। বনের প্রাণীগুলোও সব ঠান্ডা সামলাতে যার যার গর্তে চলে যায়। এদিকে বুড়িমাও প্রতি সকালে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে কিছু না পেয়ে ভুখা পেটে ঘুমোতে থাকে। এমন করে করে সে অসুস্থ্য হয়ে যেতে শুরু করে। রাতের আঁধারে ক্ষুধার যন্ত্রণায় বুড়িমা কাঁদতে থাকে আর বলে, 'আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে, আমাকে কিছু খেতে দাও!' ... ঝোপঝাড়ের আড়াল বেয়ে, শুকনো, খটমটে গাছগুলো ভেদ করে শহরের কারো কানে সেই কান্নার শব্দ পোঁছায় না।
দিনে দিনে ওদিকে শীত বেড়েই চলেছে। বরফ ঝড়ে ভেঙ্গে পড়েছে গাছের ডাল।
এক শহরের সঙ্গে আরেক শহরের যোগাযোগবিচ্ছিন্নতা। এমনই এক রাতে বুড়িমা ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে না পেরে লাঠিতে ভর করেই ছুটল বনের বাইরে। রাতের বেলায় বুড়িমা তো কিছুই দেখে না চোখে, তবু দীর্ঘদিনের চেনা বনের পথ আন্দাজ করে করে সাবধানেই এগোতে লাগল সে।
বনের পথ শেষ হলেই প্রধান সড়ক। সড়কের অপর প্রান্তে বুড়িমা একটা বাড়ির জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলতে লাগল, 'ভেতরে কেউ আছো? আমাকে কিছু খেতে দাও, ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।' কোন সাড়া নেই। বুড়িমা আস্তে আস্তে টোকা দিল জানালায়। তবু কেউ কোন শব্দ করল না। বুড়িমা এতোটা পথ হেঁটে আরো দূর্বল হয়ে গেছে। নিস্তেজ হয়ে সে জানালার পাশেই বসে পড়ল।
বুড়িমা যেই বাড়ির জানালায় টোকা দিচ্ছিল, সেটা ছিল আসলে অন্তুদের বাসা। অন্তু আবার রাতে ঘুমোত না। তাই সে রাতের বেলায় নানাকিছু নিয়ে খেলত, বই পড়ত। সেই রাতে অন্তু ফায়ার প্লেইসের আলোয় দেয়ালে নিজের হাতের ছায়ায় নানাকিছু বানাচ্ছিল। হঠাত জানালায় টোকা শুনতে পেয়ে তার কিছুটা ভয় লেগে গেলো। তারপর কি যেন ভেবে সে জানালা খুলে ডান বাম তাকাল। হু হু করে ঘরের ভেতর শীতের বাতাস ঢুকে যাচ্ছিল, নিমিষেই অন্তুর নাক লাল হয়ে গেলো। অন্তু জানালা বন্ধ করবে তখনই তার চোখ পড়ল জানালার নিচে, সেখানে সে দেখতে পেলো বুড়িমা বসে আছে। অন্তু গলার স্বর নামিয়ে প্রশ্ন করল, 'জানালার পাশে বসে আছো, কে তুমি?'
কোন উত্তর পেলো না। অন্তুর কেমন ভয় লাগল। সে আবার জানতে চাইল, 'তুমি কে?' তবু কোন সাড়াশব্দ নেই।
গলার স্বর আরেকধাপ বাড়িয়ে অন্তু তড়িঘড়ি জানতে চাইল, 'কে তুমি?' এই না বলে অন্তু যেই না জানালা বন্ধ করতে যাচ্ছিল, বুড়িমা খপ করে অন্তুর হাত ধরে ফেলল। আর বলল, 'এক্ষুণি আমাকে কিছু খেতে দাও, মুরগির ঝোল দাও, আমি ভাত খাব।'
অন্তু ভয় পেয়ে হাত হ্যাঁচকা টানে যেই না সরাবে, বুড়িমা উঠে দাঁড়িয়ে অন্তুকে ফিসফিসিয়ে বলল, 'হয় আমাকে মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত দাও, নয়ত তুমি আমার খাবার হও।' ভীষণ ভীতসন্ত্রস্ত অন্তুর তখন পড়ি কি মরি অবস্থা। সে বলল, 'আমার হাত ছেড়ে দাও বুড়িমা। তুমি যা চাও, তাই হবে।'
বুড়িমা তখন বলল, 'তবে তাই হোক। আজ থেকে রোজ সন্ধ্যায় তুমি আমাকে মুরগির ঝোল আর সাদা ভাতের যোগান দেবে, নয়ত তুমি আমার খাবার হবে।'
অন্তু ভয় পেয়ে কিচ্ছুটি না ভেবে রাজি হয়ে গেলো।
এভাবেই অন্তুদের বাসার মুরগির খামার থেকে প্রতিদিন মুরগি গায়েব হতে লাগল। সপ্তাহ শেষে খামারে তখন মুরগি আছে আর মোটে তিনটা। অন্তুর মা মুরগির স্যুপ করবে, কিন্তু গিয়ে দেখে তার মুরগি উধাও! রাতেই সে অন্তুর বাবাকে সব ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে অন্তুর বাবাও তো মহা চিন্তিত। পরদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা বাসার ছাদে উঠে, গরম কাপড় গায়ে চাপিয়ে অন্তুর বাবা বসে রইল, ঘটনার পেছনের রহস্য অনুসন্ধানে। সন্ধ্যার আঁধারে সে যা দেখতে পেলো, তাতে তো তার আক্কেল গুড়ুম হবার যোগাড়! সে দেখলো, খামার থেকে মুরগি নিয়ে বনের দিকে ছুটে যাচ্ছে অন্তু! অন্তুর বাবার তো মাথায় কিছুই খেলছে না। তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতরে গিয়ে সে বসল অন্তুর মায়ের সঙ্গে পরামর্শে। সব শুনে মা বলল, অন্তুর সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হবে। কিন্তু এমনভাবে কথা বলতে হবে যেন অন্তুর মনে হয়, বাবা মা এ বিষয়ে কিছুই জানেনা।
পরদিন সকালে অন্তু স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মা পৌঁছাল তার ঘরে। বলল, 'অন্তু, আজ আমরা বনের পথ ধরে স্কুলে যাব। তোমারও ভালো লাগবে। কিন্তু অন্তু তো কিছুতেই রাজি না সেই পথে যেতে। মা বলল, 'চলোই না, আমরা দু'জন বনের পথে কনকার্স জমাব।' অগত্যা অন্তুর যেতেই হলো। মা'র তো ভেতরে ছিল উদ্বেগ। অন্তু কেন বনের ভেতরে রাত বিরাতে মুরগি নিয়ে একা একা ছোটে, সেটা খুঁজে বের করা। মা আর অন্তু বনের ভেতরে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, ওদিকে অন্তুরও দমবন্ধ হয়ে আসছে, মা বুঝি সব টের পেয়ে গেলো! বুড়িমার কুঁড়েঘর থেকে অন্তু আর দশ কদম দূরে। ঠিক তখনই অন্তু গলা ঝেড়ে কাশল। বলল, 'মা, থামো, তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।'
মা-ও ভেতরে ভেতরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিন্তু মুখে যতোটা সম্ভব হাসি ধরে রেখে জানতে চাইল, 'কি বলবে অন্তু?'
অন্তু তখন সেইরাতে বুড়িমার দেওয়া শর্ত থেকে শুরু করে কেমন করে বুড়িমার সঙ্গে তার পরিচয় সব খুলে বলল মাকে। মায়ের তো তখন ছোট্ট অন্তুবাবুর জন্য দারুণ আদর জমেছে বুকে! মা বলল, 'তুমি কেন আগে আমাদের খুলে বলোনি অন্তু? বুড়িমা তোমাকে যে শর্ত দিয়েছে সেতো ক্ষুধার যন্ত্রণায়। কিন্তু তুমি ভয় পেয়ে মা বাবাকেই কিছু বলোনি। একা একা সব সামলে নিতে গিয়ে কেমন বিপদে পড়ে গেছো দেখেছ?'
অন্তু দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলে বলল, 'উফ মা, আমি তো ভেবেছি, তোমরা আমার কথাই শুনবে না, কিছু বিশ্বাসই করবে না! ধন্যবাদ মা, আমার কথা শোনার জন্য।'
মা বলল, 'আমার লক্ষীসোনা, তোমার কথা কেন শুনব না? কেন বুঝব না? মা-বাবার সাথে কিছু লুকিও না আর, কেমন? যদি তুমি এর চাইতেও বড় কোন বিপদে পড়তে, তখন কেমন হতো?'
মা এরপর অন্তুকে সঙ্গে নিয়ে বুড়িমার কুঁড়েঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। বুড়িমা তখন নিজের সাদা চুলগুলো আঁচড়াচ্ছে। মা বলল, 'বুড়িমা, আসব?'
বুড়িমা তো আবাক! জানতে চাইল, 'কে তুমি?' মা বলল, 'আমি অন্তুর মা। তোমাকে আমরা আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে এসেছি, তুমি আমাদের সঙ্গে বাড়ি যাবে?'
এই আকস্মিক প্রস্তাবে বুড়িমার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল পানি। বুড়িমা বলল, 'দাঁড়াও মা, চুল বেঁধে নিই!'
এভাবেই অন্তু, অন্তুর মা বুড়িমাকে সঙ্গে করে ফিরল বাড়ি। ওদিকে অন্তুরও শীতকালীন ছুটি শুরু হলো। স্কুল ছুটির দিনগুলোতে অন্তু প্রতি রাতে বুড়িমার পাশে বসে মজার মজার সব গল্প শুনে রাতে ঘুমোতে শুরু করল। যেই অন্তুর ঘুম আসত না, সে এখন নিয়ম করে গল্প শোনে, নিয়ম করে ঘুমোয়। অন্তুর মা দু'জনের জন্য মুরগির স্যুপ করে দেয়, দু'জনে মহা আনন্দে সেটা খায়। অন্তু ঘুমিয়ে গেলে অন্তুর বাবা পা টিপেটিপে এসে ফায়ার প্লেইসের আলো কমায়।
বনের সেই কুঁড়েঘরটায় এখন আর কেউ থাকে না। শুনেছি, সেখানে এখন কাঠবিড়ালী ঘর পেতেছে।