বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

মনে হয়, শতাব্দী ধরে ঘুমিয়ে আছি
কোন গোপন স্বপ্নে ঘটছে এসব শহুরে টানাপোড়েন
যেখানে আত্মা বিকাশ লাভ করেনি,
যেখানে আত্মিক শুদ্ধতা সভ্যের দাবীদার নয়।
হিংস্র, কপট রাবণের মত; 
কেবলি হরণ করছে এই রাত-ঘুম!

কিংবা আমার অসুখ করেছে খুব,
স্বপ্নের ও পিঠে সুখ আছে জেনে দিন গুণি

এমন হলেও জীবন মধুর মত বিস্বাদ হত না!

রবিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৩

কেন এমন করে কাঁদো?


জীবন, কেন এমন করে কাঁদো?
তোমার কাঁধে অনেক বোঝা, সে আমি জানি।
পরতে পরতে জমাট বাঁধে রক্ত, গুমোট অভিমানে।
চোখের পলকে যদি মনে পড়ে বিগত দিনে
উচ্ছল চঞ্চলতায়  শৈশব করেছ পাড়;
তবে হেসে হেসে গাছের সবুজ পাতায়-
বনানীতে, ঘাসের বুকেতে ওম দিয়ে
জানান দাও, আজ তুমি বড় খুশি!
তবে কি জানো না, এভাবেই রক্তের দাগ
ধুয়ে মুছে কালিমা করবে অতিক্রম তোমায়?

জীবন, কেন এমন করে বাঁচো মুখ লুকিয়ে?
জীবন, কেন এমন করে কাঁদো?

বেহিসেবে যায় যদি কিছুটা অনেকখানি সময় তোমার
সে সময় তোমারই মুক্তির দাবী নিয়ে
মিছিলে শ্লোগান তোলে।

দেখো, আকাশ মেঘেদের সারিবদ্ধ করে হাঁটতে শেখায়!
দেখো,সমুদ্র ঢেউ নিয়ে এক্কাদোক্কা খেলে সুনিপুণ মুহুর্ত রাঙ্গিয়ে!
দেখো, অবিরাম কৌশলহীন আলিঙ্গন ফিঙে পাখিদের!
ওদের কোথাও কোন শুরু নেই, শেষ নেই
ওদের কোথাও কোন আক্ষেপ নেই
ওদের কোথাও কোন মাঝপথে থেমে যাওয়া নেই।

জীবন, তোমার রোদমাখা শরীরের পাশাপাশি আমিও আছি তো ঠিক
কেন এমন করে কাঁদো? ...


সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০১৩

ইচ্ছে 

আমি ধীরে হারাব, মেঠোপথে
ধূলায় গা ধুয়ে-নেয়ে নিব
নিষ্পাপ পুকুরের জলে
মিষ্টি রোদের ওম মেখে নিতে নিতে 
সন্ধ্যা দেখব কোন পাড়াগাঁয় পিদিম জ্বালিয়ে

শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৩



যোগাযোগ



মিনার্ভা ফোন একবার হাতে নিচ্ছে, খুঁজে বের করছে নাম্বারটা ... আবার ভাবছে, কথা বলবে কিনা। এভাবেই প্রায় আধ ঘন্টামতন কাটল। এমনই হয়, ভাবতে ভাবতে, দ্বিধায় তার বেলা অবেলা হয়ে যায়, অনেকটা সাহস যখন সে সঞ্চয় করে, তখন মাঝরাত। তাই কথা বলা হয় না। কিন্তু মিনার্ভা জানে, তাকে বলতেই হবে কথাগুলো। এমন নয়, না বললে পৃথিবীর খুব একটা ক্ষতি কিছু হবে, মৃদু বাতাসে গাছের পাতা দুলে উঠবে না, ঘাসের সবুজ রং ম্রিয়মাণ হবে। এমন নয়, তার অথবা অনন্যর সময় থমকে দাঁড়াবে, তবু মিনার্ভা জানে, যদি সে না বলতে পারে কথাগুলো, তবে মনের এক কোণে যে ব্যাকুলতা, তা থেকে মুক্তি মেলা ভার। অথচ মিনার্ভা ছাড়া আর কে জানে, এই ব্যাকুলতাই তার একমাত্র স্বপ্ন!

তবু সূর্য্য যেমন শ্রাবণ মেঘের ভেলার সঙ্গে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হলে ইচ্ছে করেই রশ্মি ছড়ায়, তেমন করেই মিনার্ভা কথাগুলো বলতে চায় অনন্যকে, তাই শ্রাবণের টুপুর টাপুর বৃষ্টিবেলায় অনন্যর ফোন বেজে ওঠে। কিন্তু এমন মুহুর্তেই মিনার্ভা আবার দ্বিধায় পড়ে, হয়ত ফোন না করলেই ভাল হত, হয়ত আরেকটু গুছিয়ে নিতে পারত নিজেকে মনে মনে। ও যে একদম জানেই না, কি দিয়ে শুরু হবে কথা? মিনার্ভা বা অনন্য কখনো তো কথাই বলেনি এর আগে! এমন কাঠপোড়া ক্ষণেই মিনার্ভার সমস্ত শরীর হিম হয়ে যায়, অনন্যর কন্ঠস্বর শোনে সে, 'হ্যালো!' ... মিনার্ভা ভাবে, এমন নিঃশব্দ ক্ষণ পৃথিবীতে নেই আর। যেন একসঙ্গে চারটে ফুলদানী ভেঙ্গে পড়ছে, অথচ কোন শব্দ হচ্ছে না, শুধুই তার হৃদয়ের উথাল পাথাল ধুকপুকানি, অনন্য সেটা টের পেয়ে যাচ্ছে। মিনার্ভা আকুল হয়ে চাইছে, অনন্য সেটা টের না পাক, অথচ এই হাড়হাভাতে নিঃশব্দ সময় তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে একটা সকরুণ আদর প্রত্যাশী বেড়ালের মত অসহায় করে ফেলেছে অনন্যর সামনে!

গ্রীষ্ম দুপুরে মাটি ফেটে চৌচির বিরান মাঠের কথা মনে পড়ে মিনার্ভার, একটা কোন ছায়া পেত যদি, ওম নিত সেখানে।

'হ্যালো, কে বলছেন?' অনন্যর আওয়াজে ওর সম্বিৎ ফেরে।

মিনার্ভা সেই ক্ষণগুলোতে ভাবে, এত দৃপ্ত আওয়াজ অনন্য কোথায় পেল? অথচ সেই আওয়াজেই মনে হয়, তানপুরা বাজছে; মনে হয়, এক পশলা বৃষ্টির ঝাপটা লাগল মুখে! স্থির হয় মিনার্ভা, বলে, 'কেমন আছেন আপনি? আমি মিনার্ভা বলছি।' আর চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করে অনন্যর মুখটা, অনন্য কি হাল্কা হাসিতে অভ্যর্থনা জানাল ওকে? নাহ, কিছুতেই সে বুঝে পাচ্ছে না, অনন্যর মুখটা এখন কেমন? ... ওপাশ থেকে অনন্য বলে, 'আমি ভাল আছি। তুমি?' ... মিনার্ভা অনন্যর 'তুমি'তে এসে থামে, ওর আরো বহুবার অনন্যর কন্ঠে তুমিটাই শুনতে ইচ্ছে করে, অনন্যর মুখে তুমি যেন পাশাপাশি বসে থাকা নিরন্তর, একসঙ্গে নিরব বাতাসের গন্ধ নিতে নিতে দিগন্ত দেখা।

কিন্তু এরপর আর যে কথা এগোয় না! দুই প্রান্তেই নিরবতার এক সূক্ষ রেখা টানা। দু'জনেই জানে, এই রেখা কল্পনা প্রসূত নয়, এখানেই ওদের থেমে যাবার নিয়ম ... অথচ কতই না কথা আছে জমে, থাকে অব্যক্ত। তবে মিনার্ভা আজ জানে, সে থামবে না। তাই ও-ই ভাঙ্গে নিরবতা।

বলে, 'শেষ আপনাকে দেখেছিলাম সবুজ রং'য়ের পাঞ্জাবীতে। দিনটা আপনার মনে আছে?'

অনন্য কি বলবে ভাবে খানিকটা। মিনার্ভা থামে না, বলে ... 'আমি জানি, আপনার ঠিক মনে আছে। কিন্তু আমি এও জানি, আপনি কিছু বলবেন না। তবে আজ জানা কথাগুলোকে অজানা করে লুকোচুরি করব বলে আমি আপনাকে ফোন করিনি। আপনার কিছু সময় আমার কাছে রয়ে গেছে, আমি ভাবছি সেগুলো পৌঁছে দিব কেমন করে। একদিন তাই সময় দেবেন?' এক নিঃশ্বাসে মিনার্ভা বলে ফেলে কথাগুলো, হঠাৎ সে বুঝতে পারে, জমাট বেঁধে যে লুকোচুরি সামলাতে চেয়েছিল তাকে, তা যেন নিমিষে উড়ে গেল শূণ্যে। মিনার্ভা কখনো ভাবেনি, অনন্যের প্রতি তার যে সম্মোহন, এই আগল তাকে এমন মুক্ত শব্দগুলো বলবার সাহস এনে দেবে!

অনন্য বড় সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ে। এত বছর পরে কেন মিনার্ভার ফোন? কোন সময় রয়ে গেছে তার যা সঞ্চয় করেছে মেয়েটা? তিনদিন ঠিক গুণে গুণে তিনদিন অনন্য মিনার্ভাকে দেখতে পেয়েছিল।  তিন বছরের ওই তিনটা দিনের মায়ায় কি অনন্যও ডোবেনি? অনন্য ভেবেছে বহুবার, নিরবতার টানাপোড়েন ঘুচিয়ে নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা। কিন্তু এক পা বাড়াতে গিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে পড়েছে সে ক্রমশ ... দ্বিধায়, ভয়ে, আড়ষ্টতায় ... যদি মিনার্ভা সব শুনে হেসে ফেলে? যদি মিনার্ভা দুষ্টু চোখের ইশারায় বলে, 'অনন্য, তুমি আমার কাছে হেরে গেলে।' অনন্য তাই জানায়নি মিনার্ভাকে, রোজ রাতে ঘুমোতে গেলেই মিনার্ভা চুপ করে এসে বসত অনন্যর পাশে, ওর স্নিগ্ধ; নিশ্চিত হাত রাখত কপালে। আর সেই হাতের ভাঁজে হাত রেখেই অনন্য সকাল দেখত। মিনার্ভা কি তবে টের পেয়ে গিয়েছিল সব? তাহলে সে কেন ভাঙ্গেনি নিরবতা? মিনার্ভাকে তো কখনোই অমন ছাঁচে ফেলতে পারে না অনন্য! মিনার্ভা তার দেখা সৌন্দর্য্যের এমন এক উদাহরণ যার জন্য অনন্য সব দ্বিধা ঝেড়ে শংকামুক্ত হতে পারত, যে একবার হ্যাঁ বলে হাত বাড়ালে অনন্য ছুটে যেত। ঘর বানাত! ...

ওপাশ থেকে অনন্য মিনার্ভার কথা শুনতে পায়, 'হ্যালো, আপনি আছেন? অনন্য বলল, 'হ্যাঁ, আছি।' মনে মনে ভাবল, 'মিনার্ভা, এখানেই থেমে যাও তুমি, আর পা বাড়িও না। কেন অকারণে পেছন ফিরে যাওয়া। আমাদের এই নিরবতা বেশ তো ছিল, আমিও তা জানি, আজ জেনে গেলাম, জানতে তুমিও। নয়ত এমন অধিকার নিয়ে কে বলতে পারে নিঃসংকোচে, আমার কিছু সময় তার কাছে আছে!'

মিনার্ভা ফোনের অপর প্রান্তে হেসে ওঠে, অনন্য ভাবে, চাঁদের রুপোলি আলোর মত মায়াময় দেখাচ্ছে মিনার্ভাকে। 'চুপ করে আছেন কেন এখনো? আজ তো আমিই চাইছি একটু সময়!'

অনন্য বলল, 'বেশ তো! বল, কবে, কখন, কোথায়?'

মিনার্ভা বলে, 'আপনার বাসার নিচে আমি দাঁড়িয়ে আছি। জানালায় এসে দাঁড়ালে আমাকে দেখতে পাবেন। আর যদি নিচে নামতে পারেন, তো আমরা কিছুদূর হেঁটে যেতে পারি।'

অনন্যর সমস্ত অনুভূতি একত্রিত হয়ে যেন দ্রিম দ্রিম বাজতে থাকে। অনন্যর ভীষণ রাগ হয়, ভাবে, মিনার্ভা, তুমি এমন কেন? এমন সাহস কোথায় ছিল তোমার? আমায় কেন বঞ্চিত করলে তুমি তবে? কিন্তু তারপর নিজেকেই ভর্ৎসনা করে সে। গ্লানিময় মনে হয় গোটা জীবন, সেও কি লুকায়নি নিজেকে! অস্ফুট স্বরে বলে, 'আসছি।'

সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে অনন্যর মনে হয়, আট বছর হাতের মুঠোয় করে নামছে সে, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, আজকের এই সন্ধ্যা তবে হোক সময় ফিরিয়ে দেবার।

সোডিয়াম লাইটের আলোয় অনন্য বুঝতে পারছে না, কি রং শাড়ি পড়েছে মিনার্ভা। তবে বৃষ্টির ছাটে ওর গা ভিজে গেছে, রাস্তার ওপাশে মিনার্ভা দাঁড়িয়ে। অনন্য বহুবার মিনার্ভাকে এভাবে আঁকতে চেয়েছে, পারেনি। আজ বৃষ্টিস্নাত মিনার্ভাকে দেখে মনে হল, এই মেয়েকে ছুঁতে গেলে যতটা শুদ্ধতার প্রয়োজন, তা বুঝি নেই ওর! ওকে একবার ছুঁলে আজীবন কোন প্রাচুর্য্যের প্রয়োজন পড়বে না!

মিনার্ভা মৃদু হেসে রাস্তার এপাড়ে চলে আসে। বলে, 'দেখলাম আপনাকে বহুদিন পর! জানেন, বিগত সময়গুলোতে আপনাকে নিয়ে একটা স্বপ্নই ঘুরেফিরে বারবার দেখেছি আমি! আমার ঘুমন্ত কপালে আপনার হাতের ছোঁয়া, সেই স্পর্শের রেশ ঘুম ভাঙ্গার পরও আগলে রেখেছে আমায় বহুদিন।' তারপর অকস্মাত দু হাত বাড়িয়ে ধরে নিল অনন্যর হাত, মুঠোভরে বলল 'এই ছিল আমার কাছে থেকে যাওয়া আপনার সময়। আপনার স্বপ্নের সাথে একেও মিলিয়ে নিয়েন। চলি।'

অনন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় দেখে নিল, মিনার্ভা মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। শ্রাবণের বৃষ্টি তখন নির্ভার আনন্দে ঝরছে!









সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩

ঘর ও ঘোর এবং অন্যান্য 

# ঘুম ভাংতেই দেখলাম কুয়াশায় ঢেকে থাকা দিনের মত রং
ঘর ঘুমোচ্ছে তা দেখে ... একটা রাতঘুম দেয়া বিছানায় হেলান দিয়ে
ওপাশ ফিরে, কাঁধের পেছনে বালিশ নিয়েছে এক। 

# দেয়াল জুড়ে আমি আর সে 
আমাদের মৃদু মৃদু হাসি 
ঘি রঙ এ আকাশের আবীর মেখে দিল
অবনত চোখ দেখে ঘর বিস্ময়ে ভাবে
স্বপ্ন দেখবে নাকি?

# যাদু সত্যি হলে ঘরের প্রতিবেশী বারান্দায়
মেঘবালিকা জল দিয়ে ঘোর বানাত আরেক
যাদু জানালার কার্নিশ গলে ভেতরে আসে না তাই
শেষ মনে আসে, শুরুটা দূরে; অজানায়।

বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই, ২০১৩

তিন কবিতা।

চোখ দেখে বুঝবে না ব্যথার উৎস
চোখ দেখে বুঝবে না অতল গহ্বর মনে করে বাস
চোখ ব্যথা গিলে খায়, নিংড়ে খায়
খুটে খুটে খায়, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খায় ব্যথা
চুইয়ে পড়ে যে ব্যথা, হাড় মাংস নিঃশেষ করে যে ব্যথা
মায়ায় বসত গড়ে বুকের মধ্যমায়.


তুমি আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলে ঠোঁট আর আষাঢ় নামল।
আকাশ কেঁপে উঠল, গর্জে ডাকল মেঘ, বৃষ্টি নামল ...
আমার প্রিয় পানা ফুল, কদম এখন ভিজছে 


কেউ জানে না আমি জানি
মুহুর্তেরা প্রহর হলে কোন ঘরেতে আলো জ্বলে
কোন ঘরেতে আলোর প্রহর নিভু নিভু ...
কেউ জানে না আমি জানি
আলো কিংবা অন্ধকারে মুহুর্তদের চিতা জ্বলে
অহর্নিশি ... হর-হামেশা
প্রখর তাপে ঠোঁট পুড়ে যায়, বুক পুড়ে যায়, চোখ পুড়ে যায়
মুহুর্তদের, কেউ জানে না ... আমি জানি!

সোমবার, ২৭ মে, ২০১৩

নস্টালজিয়া

-আচ্ছা, এই এলাকায় কদম গাছ কোথায় পাব?

লীলাবতির এমন প্রশ্নে রোকন বিস্মিত হয়ে গেছে। সে মনে করতে পারল না কখনো কেউ তাকে এমন উদ্ভট প্রশ্ন করেছে! ... তাই সে না শোনার ভান করল।

লীলাবতি এবার গলার স্বর একধাপ বাড়িয়ে জানতে চাইল ...

-এই যে ভাই, এই এলাকায় কদম গাছ কোথায় পাওয়া যাবে?

রোকন এবার মাথাটা কিঞ্চিৎ ডান দিকে ঘুরিয়ে বলল 'আফা, আমারে জিগান?'

-হ্যাঁ! ... আপনি ছাড়া আর তো কেউ নেই আশেপাশে! আর আমাকে দেখে কি আপনার পাগল মনে হচ্ছে যে একা একা কথা বলে? ... বলল লীলাবতি।

- জ্বে না আফা! তয় ফাষ্টে বুজিনাই, কি কইতে কি কমু, তাই কিছু কইনাই। ড্যাবড্যাব করে তাকায় রোকন পেছনে।

-আরে আরে সাবধানে যান, করছেন কি! দিলেন তো সব ভিজিয়ে!

-স্যরি, আফা ... ঝটপট বলে রোকন।

-অসুবিধা নেই, আচ্ছা, জানেন আপনারা যে, যখন তখন বৃষ্টি নামে, পর্দা কেন রাখেন না? একরাশ বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে লীলাবতি। ওর কালো ফ্রেইমের মোটা চশমার পেছনে ততোধিক কালো; পেলব; পুষ্ট ভ্রুযুগল বক্ররেখার মত হয়ে গেছে বিরক্তিতে। আর সে মনে মনে ইচ্ছে পোষণ করে, জিপ গাড়িটার কাঁচ সে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইঁট ছুঁড়ে ... চুড়মাড় ভেঙ্গে পড়ছে কাঁচ, আর চালকের মুখ পাংশুটে হয়ে গেছে। কিন্তু লীলাবতি জানে, ইঁট ছুঁড়ে মারতে সে পারবে না কোনদিন, তাই তার ভ্রুগুলো আরো বাঁকা হয়ে যায় ক্ষোভে। এই গাড়িওলা মানুষেরা খুব ইন্সেন্সিটিভ হয়, ভাবে লীলাবতি। ভাবতে ভাবতে হাত-পা ঝাড়া দিতে থাকে।

এর মাঝে বেশ অনেকটা রাস্তা পাড় করে এসছে রোকন, রিক্সা চলছে দারুণ গতিতে। ঝুম ঝুম বৃষ্টি পড়ছে খোলা রাস্তায়, সাত মসজিদ রোডে কোন জ্যাম নেই দুপুরের এই স্কুল ছুটির সময়টাতেও! ঠান্ডা হাওয়া মাধুর্য্য ছড়াচ্ছে লীলাবতির মনে, সে বৃষ্টির সৌন্দর্য্যে আনন্দিত হতে হতে হারায় ভ্রুর বক্রতা। ফুরফুরে হয়ে ওঠে মন তার, বৃষ্টিবাতাসের মত!

-লীলাবতি বলে, ভাই, বললেন না! কদম গাছ কোথায় মিলবে?

-আফা, আপনে কি ডাকায় নতুন আইসেন?

-উহু ... বলে লীলাবতি, তবে এই এলাকায় নতুন।

-আইচ্ছা, সামনেই একটা কদম গাছ পড়ব। যাইবেন?

-'হ্যাঁ, ওখানেই নিয়ে যান।' লীলাবতি এ বছর কদম দেখেনি। সে পুরো একটা বছর কদম কালের অপেক্ষায় থাকে, আজ সেই অপেক্ষা পূরণ হবার দিন, ভাবতেই ভাল লাগে তার। আনমনে প্রশ্ন করে রোকনকে, 'ভাই, আপনার নাম কি?' রোকন যেন আরো অবাক হয়। মুখে যদিও নাম বলে তার ... লীলাবতি থামে না, সে জানতে চায়, কোথায় তার বাড়ি, পড়াশোনা করেছে কিনা, বাড়িতে তার আর আছে কে কে? ... রোকন সব ঠিক উত্তর দেয় তার। শুধু কেন যেন তার বলতে ইচ্ছে করে না, এই আফার কাছে, ময়নার নাম (ময়না তার হবু বউ, এক বাড়িতেই থাকে)!

রিক্সা এসে থামে ধানমন্ডি সাতাশের মাঝামাঝি। 'এই পার্ক দইরা নাক বরাবর আইটা গেলে আফা দ্যাকবেন কদম গাস।' বলে বিরাট এক হাসি দেয় রোকন, তার কেন যেন মনে হয়, এমন সুখের কাজ করেনি সে জীবনে আর কোনদিন! ... লীলাবতি ভাড়া দিতে দিতে গলা চড়িয়ে প্রশ্ন করে, 'আচ্ছা রোকন ভাই, আপনি সারাদিনে কত রোজগার করেন?' ... তারপর রোকনের খোলা মুখ থেকে শব্দ বেরুবার আগেই বলে বসে, 'আমি যদি আপনাকে একদিনের খরচ দিয়ে দেই, আপনি আমার সঙ্গে এখন ওই কদম গাছের কাছে দাঁড়াবেন গিয়ে?  ...

এভাবেই রোকন আর লীলাবতি কোন এক বৃষ্টি দুপুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাক ভেজা হয়ে কদম দেখেছিল। লীলাবতি দেখেছিল কদমফুলের গা ধুয়ে নেমে আসা টুপটাপ জল, পাতার সবুজ আর রোকন দেখেছিল আফার চোখে মুখে ফুটে ওঠা সুখ সুখ অনুভূতি, বৃষ্টি ফোঁটায় স্নাত।







বুধবার, ২২ মে, ২০১৩

খোলা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঝুম বৃষ্টি অনুভবের কথা ভাবলেও শিহরণ লাগে।
মাঝে মাঝে একা রাত অর্ধেক হলে পরে ঘরের ঘোর খুলে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে পথে,
তারপর সকাল হবে কি না হবে সেই চিন্তাও আসে না কখনো 
... এমন করে হেঁটে হেঁটে কোন দূর চায়ের দোকানে বসে গল্প গুজব,
গামছার আড়লে খেটে খাওয়া মানুষের কাঁধ, উচ্ছল হাসি ... 
সে হাসিতে মায়া আছে খুব, কিন্তু তা মায়ার বাঁধন থেকে মুক্ত বড়! 
মাঝে মাঝে তুমি প্রশ্ন করার আগেই তোমাকে জানাতে ইচ্ছে করে ভালবাসি কিনা,
তাই মাঝে মাঝে তুমি চুপ করে থাকো আর আমি জিজ্ঞেস করি, ভালবাসো? ...
এমন হয়, কোন গান শুনে মনে হয়, এই গান শুনে শুনেই মরে যাব, এই গান শুনতে শুনতে
আরো পবিত্র হব, বিষাদের বিবমিষা লেগে থাকবে গায়ে
শরীরের ত্বক চিড়ে ঢুকে পড়বে আত্মায় অলি গলিতে
সেই গান তোমাদের সবাইকে শোনাব!
কখনো ফেলে আসা কার কথা মনে পড়ে
মনে পড়তেই মনে পড়ে যায়, হায়! কত পথ হাঁটা ছিল বাকি!
মাঝে মাঝে তার এক ইশারায় চোখের বাঁধন খুলে মাঠের শেষ কোণে গিয়ে মুখ লুকাই।

শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৩

দৃশ্যপট মহাখালী ফ্লাইওভার। এক ঘন্টা যাবৎ রেজা জ্যামে আটকে আছে। গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে ঢাকা গাড়ির গরমেও অগ্নিকূপে পরিণত হয়। ছুটির দিনে রেজা বাসায় ঘুমাতে পছন্দ করে। কিন্তু আজ বেরোতে হল, মামার বাসায় আগের রাতে আট হাজারে কেনা ইলিশ মাছের  কোপ্তা দিয়ে আসার জন্য। সে ভাবে, 'গাড়ি থাকতে চিন্তা কি? যাব আর আসব' ... কিন্তু ছুটির দিনেও রাস্তায় গাড়ির জ্যামে আটকে রেজা রাগে দুলতে থাকে। যদিও গাড়ির বাইরে রাস্তায় হেঁটে চলা জীবন যাদের, তাদের তুলনায় রেজা বেশ আরামেই আছে, অন্তত ভ্যাপসা গরমে এসির ঠান্ডা বাতাস আর হাল্কা ভলিউমে হৃদয় খানের গান পথিকের জীবন থেকে তো আলাদাই করেছে তাকে !

শুক্র আর শনিবার ছাড়া সাপ্তাহিক বাকি দিনগুলোতে রেজা অসম্ভব ব্যস্ত। নামী ব্যাংকে বড় পোস্টে চাকরিজীবী সে। মনে মনে তার চাইতেও বেশি প্রণোদিত রেজা, তার মোটা অংকের বেতনের কথা ভেবে। জীবনের কোথাও দৃশ্যত কোন ক্লেদ নেই তার! ঘুষখোর বাবার রেখে যাওয়া অঢেল সম্পত্তি, ঢাকা ইয়ুনিভার্সিটির বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিগ্রী, প্রেমের সফল পরিসমাপ্তি বিয়েতে, আজ্ঞাবাহী বৌ, যে ঘরে-বাইরে রেজার পাশে শোভা বর্ধনের জন্য যথেষ্ট, দুটো ফুটফুটে ছেলে মেয়ে, ঢাকায় দাপিয়ে বেড়ানোর জন্য দামী গাড়ি, শহরের নামী এলাকায় বাড়ি ... ছেলে মেয়েদের ইংলিশ স্কুলে পড়াশোনা।

রেজা হৃদয় খানের গান শোনে আর ভাবে মেয়েটাকে তার গান শেখাতে হবে, পাশাপাশি আর্ট স্কুল আর নাচের ক্লাস। ইদানীং এসব না করলে বসদের সঙ্গে আড্ডায় পেরে ওঠা যায় না। মেয়েকে সামলে নেওয়ার জন্য বৌ তো আছেই। সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব এ সমাজে আছে, কিন্তু বখে না গেলেই হল! বাসায় হুজুরের কাছে কুরাআন  শিক্ষাও চলবে। তার মনে হয়, ধর্মীয় শিক্ষা মেয়েকে বখে যাওয়া থেকে বাঁচাবে। মেয়ে বড় হলে যদি গানের সিডি বের করতে চায়, অর্থের অভাব হবে না। রেজা ভাবে আর হাসে ... তার ছোট্ট মেয়ে বড় হবে, গান করবে। নাচ আর ছবি আঁকাটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাওয়া ভাল। ওগুলো মানুষের ছোটবেলার সময় কাটানোর সেরা অনুষঙ্গ হতে পারে, কিন্তু বড়বেলার জন্য রিস্কি!

মটরবাইকের হর্ণে তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে। ঢাকা শহরে এই হয়েছে এক জ্বালা। যার তার হাতে পয়সা চলে গেছে, যে সে চাইলেই যান কিনে ফেলে আর রাস্তায় জ্যাম বাঁধায়, ভাবে রেজা বিরক্তিভরে। সভ্য সমাজে চলার নিয়ম কানুন এদের অজানা! রেজা পারলে সব্বাইকে এক হাত দেখে নেয়, এইসব ছোটলোক, নির্ঘাত কম মাইনেতে ছাপোষার মত বেঁচে থাকে, আবার রাস্তায় রাজা বনতে চায়, রেজা গালি দেয় লোকটাকে 'ব্যাটা খা*** পুত'!

আজ শনিবার। অর্ণব চায়নি বেরোতে। তার অফিস বনানীতে। একটা অ্যাড ফার্মের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর সে। প্রচলিত পড়াশোনায় তার অরুচি। তার স্বপ্ন ছবি বানানো, বিটার মুন দেখার পর থেকে তার জীবনে অদ্ভূত বাঁক আসে। সে বিভোরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয় নিজেকে!

অর্ণব বোদলেয়ার পড়ছিল, 'আমি ভালবাসি ওই আশ্চর্য মেঘদল ...'  এর মাঝে আসিফের ফোন। (আসিফ তার অফিসের ডিরেক্টর)

আসিফঃ পাগলা, কি করিস?
অর্ণবঃ শেষ মেঘ দেখেছি কবে, মনে পড়ে না আসিফ ভাই।
আসিফঃ আকাশে খুঁজতে খুঁজতে একবার একটু ঘুরে যা।
অর্ণবঃ জরুরি কিছু?

আসিফ জানায়, ব্লুজ কালারের বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্টটা খুব দরকার। ক্লায়েন্ট এসছে। অর্ণব যেহেতু আইডিয়া জেনারেইট করছে, তারা ওর সঙ্গে আলাপ করতে চায় জরুরি ভিত্তিতে। তাদের কিছু পরিবর্তন চাই।
অর্ণব মেঘদলের ওড়াউড়ি থেকে ছিটকে এসে পড়ে ক্লায়েন্টের পছন্দ অপছন্দের ভাঁড়ারে। বিষাদে, অপারগতায় আবারো কুঁকড়ে ওঠে সে ভেতরে। কম্প্রোমাইজ হয়ত করতে হবে আবারো স্ক্রিপ্টে, ভাবতে তার ভাল লাগে না আর। আসিফকে শুধু বলে দেয় 'আসছি।'

ঘড়ির কাটায় একটা চল্লিশ, বাইক নিয়ে আসিফ যখন মোহাম্মদপুর থেকে বেরিয়েছে। আর মহাখালী ফ্লাইওভারে রেজার গাড়ির পাশে এসে সে যখন জায়গা চাচ্ছে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, তখন বাজছে তিনটা দশ। প্রচন্ড গরমে, রাস্তার জ্যামে হঠাৎ তেঁতিয়ে ওঠা অর্ণব জীবনের গন্তব্য নিয়ে ভাবতে থাকে আর বিচলিত, বিরক্ত হয়। সে দেখে রাস্তায় তার বয়স্ক একটি ছেলে বাদাম বিক্রি করছে, আরো ছোট একজন মিনারেল ওয়াটার। সে মানিব্যাগ খুঁজে ত্রিশ টাকা বের করে, পানি কেনে, বাদাম কেনে। খেটে খাওয়া মানুষ তার বড় প্রিয়। তার চাইতেও শ্রদ্ধা করে সে তাদের ঘাম। ওরা জীবন নিয়ে কি ভাবে? ওদের তুলনায় নিজেকে বড় বিলাসী মনে হয় তার আর মনে মনে তুচ্ছ মনে হয় তাকে। ও ফিরে যায় আশ্চর্য মেঘদলে ... হায়, এরা শেষ কবে মেঘ দেখেছিল? অথবা মেঘ দেখার সাধ কি মনে জাগে এদের?

... রেজার কন্ঠে জ্যামের নগরীতে ফেরে অর্ণব।

রেজাঃ কি ভাই! কত বড় মাস্তান হইছেন?
অর্ণবঃ (তীর্যক প্রশ্ন উপেক্ষা করে বলে) আপনি ডানে সরে গেলে আমি অনায়াসে চলে যেতে পারি, তাড়া আছে।
রেজাঃ আপনের তাড়া আছে, তাড়া তো ভাই আমারো, কিন্তু বাইক নিয়া প্রাইভেট কারের সঙ্গে মশকরা করবেন তা তো বেমানান!
অর্ণবঃ (বিস্মিত আর রাগ চেপে জানতে চায়) ভাই, বুঝলাম না!
রেজাঃ আমার এই গাড়ির দাম জানেন কত? এইটারে পিছে ফালায়া আগে যাবেন, চিন্তাটা পছন্দ হইল না। দিলাম না জায়গা। যান দেখি ... !

অর্ণব মুহুর্তে তার বাবার মুখটা মনে করে। একজন সৎ, ভালো মানুষ। কিন্তু মানুষের চতুরতা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তাদের ওপর ভরসা করে ব্যবসা দাঁড় করানোর নিস্ফল চেষ্টা করে এখন নিঃস্বপ্রায়।  একজন স্বপ্নবাদী সে, তাই এখনো স্বপ্ন দেখেন বড় বড়। বাবা শেষমেষ তাদের শখের গাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগেও প্রয়োজন হলে বাবাকে লোকাল বাসে জার্নি করতে হয়েছে তাই। ইদানীং বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় অর্ণব বাবাকে বেরোতে নিষেধ করে। তার পাশে গাড়িতে যে লোকটা, তার সঙ্গে বাবার পার্থক্য খুঁজতে থাকে অর্ণব।

রেজাঃ (গাড়ির কাচ বন্ধ করতে করতে) যত্তসব আবোল তাবোল ছাগলের জায়গা হইসে এই শহর।

রেজার শেষ শব্দগুলো অর্ণবের মাথায় ঝিম ধরিয়ে দেয়। সে বাইক স্টার্ট করে আর এগিয়ে যেতে থাকে। ততক্ষণে জ্যাম ছুটতে শুরু করেছে। কিন্তু ফ্লাইওভার পাড় হয়ে সামনে এগোতেই গাড়িটি তাকে একপাশে আটকে রেখে চলতে থাকে! রেজা আর সহ্য করতে পারে না। সে গতি বাড়িয়ে গাড়িটাকে রাস্তার ডানদিকে চাপতে বাধ্য করে। তারপর সামনে এগোয়।

অফিসে পৌঁছে অর্ণব দেখে আসিফ ভাই আর ক্লায়েন্ট তার জন্য অপেক্ষা করছে। ক্লায়েন্টের ডিমান্ড স্ক্রিপ্টে ছোট্ট মেয়ের চরিত্র বাদ দিয়ে কোন তরুণীকে ইন করানো। আর সেই চরিত্রের রুপায়ন করাতে চায় তারা কোন নায়িকাকে দিয়ে। ভদ্র ভাষায় স্ক্রিপ্ট পরিবর্তনে অপারগতা জানায় অর্ণব, ক্লায়েন্ট নাছোড়বান্দা! আসিফ ভাই কনফারেন্স রুমের টেবিলের তলা থেকে অর্ণবের হাতে টোকা দিয়ে অনুরোধ করে চেপে যেতে, কারণ এই পার্টি তাদের সঙ্গে পুরো তিন বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করার আগ্রহ দেখাচ্ছে, যেটা তার প্রতিষ্ঠানের জন্য লাভজনক। অগত্যা চুপ করে যায় অর্ণব।

বিকেলের রোদে অফিস থেকে বেরিয়ে মোড়ের দোকানে গিয়ে সিগ্রেট ধরায় সে। হঠাৎ মেঘদল চোখে পড়ে তার। সে মনে মনে বিড়বিড় করে ওঠে 'আশ্চর্য মেঘদল/ কালে কালে কত তুমি এলে?' চাপা দীর্ঘশ্বাস মনের কোণ থেকে বেরোয়, মেঘদল তাকে চুরি করে এগিয়ে যায় কিনা, অর্ণব জানে না। সে পা বাড়ায়, মটর বাইকে স্টার্ট দিয়ে ভাবে চারুকলা যাবে। এগোতে থাকে সে। কিন্তু কিছুদূর যেতেই লুকিং গ্লাসে সে দেখে ওই গাড়িটি ফলো করছে তাকে! অর্ণব প্রশ্রয় না দিয়ে এগোতে থাকে, তার বিভোরের কথা মনে পড়ে। সে ভাবে, এত বড় শহরে কেউ নেই, মনের বিষাদগুলো অধিকার করে নেয় এমন!

এরই মাঝে ঘটে ঘটনাটা। রেজা সুযোগ বুঝে একটা লোকাল বাস আর তার গাড়ীর মাঝে ফেলে দেয় অর্ণবকে। প্রবল এক ঝটকায় তাকে বাসের গায়ে লাগিয়ে দিয়ে সামনে চলে যায়। অর্ণব খেই হারিয়ে রাস্তায় পড়ে। তার বাইক থেকে ছিটকে যায় সে কয়েক হাত দূরে। কপাল গড়িয়ে রক্ত পড়তে থাকে, জ্ঞান হারায় সে, কিংবা হয়ত তার শেষ নিঃশ্বাসকে সঙ্গী করে নিয়েছিল মেঘদল!

(সেই রাতে রেজা ঘরে ফিরে দেখে, তার ছেলেটা জ্বরে কাতরাচ্ছে বিছানায়। চিৎকার করে বলে 'বাবা, মেঘ আসছে, মেঘ ... দৈত্যের মত, আমাকে নিয়ে গেল বাবা।' ... আর বাইরে কালবৈশাখী ঝড়। সে মোবাইল ফোনে চেষ্টা করে নেটওয়ার্ক পায় না, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে করে ঘর থেকে কোলে তুলে নেয় সাড়ে  চার বছরের শিশুপুত্রকে। কিন্তু বেরিয়ে দেখে তার গাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে গেছে ঝড়। সেটি আর চালাবার জো নেই। গাড়ির এমন পরিস্থিতি দেখে রেজা আবার রেগে ওঠে। সে এই দেশের প্রকৃতিকে গালি দিতে থাকে, জোরে জোরে বলতে থাকে 'বা** এক দেশ! বা** বৈশাখ।'  আর হঠাৎ লক্ষ্য করে, তার শিশুপুত্রের নিস্তেজ দেহ লুটিয়ে পড়েছে ...)

... কিন্তু এমন হয় না। যেমনটা হতে থাকে প্রতিনিয়ত ...

 রেজা  তার দামী গাড়ি দিয়ে অর্ণবকে চাপ দিয়ে মনের অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেয়েছিল, ভেবেছিল, গেলাম জিতে। সে মনে মনে হেসে উঠেছিল ভেবে, ফকিরটার জায়গা এবার হবে আস্তাকুঁড়ে। ঠ্যালা সামলা ব্যাটা, আমার গাড়ির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার ঠ্যালা সামলা। ব্যাটা, রাস্তায় চালাবি বাইক, আর আমি চালাই প্রাইভেট কার। তোর সময় বা জীবন কি ব্যাটা আমার থেকে বড়! ... সে বেসুরো গলায় গায়, 'চাই না মেয়ে তুমি অন্য কারো হও, পাবে না কেউ তোমাকে, তুমি কারো নও ...'





বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৩

সমুদ্র যখন নিরব হয় তাকে দেখেছ?
সারি সারি একগুয়ে ঢেউ প্রতিবার আছড়ে পড়ে
একবার, দুবার, তিনবার ...
একবার দুবার তিনবার।
মানুষ এসে চলে যায় তার সঙ্গে মৃদুমন্দ বাতাস।
সমুদ্রের তাতে চোখ নেই, নিরুত্তাপ!
কত জল নিয়ে অমন নিশ্চুপ হওয়া চলে?
আকাশ কখনো মেঘ রঙ, কখনো চলিষ্ণু মেঘ
নিয়ে খেলা করে। বৃষ্টি ঝরায়! 
বরাবর আকাশ ভালবেসেছি আমি,
ওখানে দেখোনি কত শোভা! সাদা মেঘ, কাল মেঘ, ছাই মেঘ
এমন কি রঙ্গে রঙ্গে হেসে ওঠা রংধনু!
কিন্তু সমুদ্রকে দেখেছ কখনো?
তুমি জেনেশুনে জেনেশুনে আমাকে সমুদ্র করে তুলছ
সমুদ্র করে তুলছ তুমি জেনেশুনে আমাকে ...
অথচ বরাবর আকাশ ভালবেসেছিলাম!
আচ্ছা, তুমি কি আকাশ বা সমুদ্র বোঝ?
আচ্ছা, তুমি কি মানুষ বোঝ? ...

মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৩

চিঠি পৌঁছুবে না,
আলিঙ্গনের অস্পৃশ্য রহস্য উঠোনে ডিগবাজি খাবে।
চিঠি পৌঁছুবে না,
উঠোন জুড়ে পায়চারি করবে ধূলো।

বিদায় বলবে না চিঠি, একার শব্দমালা
রাতজাগা চোখের ক্লান্তি দেখবে উঠোনের কোণ থেকে।
চিঠি উড়বে না আকাশে, মেঘ ছোঁবে না।

পরিচিত অন্দরে পুড়বে হৃদয় প্রকোষ্ঠে।
পুড়ে হবে খাক, পুড়ে অঙ্গার বিবর্ণ হবে।
দরজায় কড়া নাড়বে যে
নাম তার 'অপেক্ষা!' ...




মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০১৩

মৃত্যুর খুব কাছাকাছি গেলে পরে টের পাওয়া যায়, মানুষ মূলত একা
গ্যাস চালিত যান চালক যখন নিরীহ মানুষের আতংকিত ছুটোছুটি দেখে
পুলিশের হুঁশিয়ারী দেখে সাধারণের মতন একার ভালটা ভেবে
মাঝপথে নামিয়ে দিল ... আমি দেখলাম
প্রাণভয়ে মানুষ ছুটছে এদিক ওদিক ...
মৃত্যুভয় মানুষকে ক্ষুধাও ভুলিয়ে দেয় নাকি! ...
ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ভাবছিলাম, এখন আমি কোন দিকে যাব!
গুলির আওয়াজ, দোকান বন্ধ করার শব্দ তারপর হিম নিরবতা।
এই নিরবতা বিলাসী আয়োজন করে একা সমুদ্র দেখতে যাওয়াকে তিরষ্কার করে। এই নিরবতা প্রিয় মুখগুলোকে মনের গহীন থেকে
চিড়ে বের করে আনে। মনে হয়, তোমরা হাসতে থেকো, ভালবাসতে থেকো, অধিকার করে রেখো প্রিয় স্বদেশ ...
তারপর আবার ফিরে যাওয়া একা রাস্তায়
কতগুলো দানবের হিংস্র আক্রমণের শংকা বুকে পুষে;
পুষে নিষ্কলংক ক্ষেদ, পুষে স্বপ্ন-পুরনো শকুনের হাত থেকে দেশ মুক্ত হতে দেখবার ... অথবা নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা ... কিংবা ভেতরের সৈনিকটাকে অনাগত মৃত্যুকে প্রতিহত করবার সাহস যোগানোর!
মৃত্যুর খুব কাছাকাছি গেলে পরে টের পাওয়া যায়, মানুষ মূলত একা।

মার্চের ০২ তারিখে লেখা। আজ ব্লগে পোস্ট করলাম। 
 
সারারাত নির্ঘুম কাটালে পিনপতনের শব্দে নিরবতা ভাংবে না
রাতের সময়টাতে একা থাকে মানুষের নিরবতা
বাতাসে বাতাসে মিশে যায় একাকীত্ব, বেড়াতে বেরোয়!
রাতের সময়টাতে ইঁদুর ছোটে সদলবলে ...
তাদের সাথে হয়ত কিছু মানুষও এমন
আহারের নিত্য যোগাড়ের চিন্তায় নিষ্পেষিত যাদের পেশী ও মন!
তারাও কি বেঁচে থাকে না? নিঃশ্বাসের প্রয়োজনে হয়ত তারাও করে
হাসি আয়োজন ... ওভাবে কি বাঁচা যায়? কিংবা ওটাকে কি বলে বেঁচে থাকা?

বাঁচার জন্যে চাই উপলক্ষ্য এমন বা এক
যাতে মনে হবে, ঘুম ভেঙ্গে গেল আর ছুটলাম
পাখির ডানায় করে ছুটলাম ... নদীভ্রমণে
জেলেদের সাথে নিয়ে মাছ খুঁজে ফিরলাম বাড়ি,
মায়ের হাতের রসে মিশে গেল চুলোর হাঁড়ির স্বাদ!
বেঁচে থাকলাম কারণ, বাবা হাত বুলিয়ে দিল আদর
বলে দিল, রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করা শিখেছ বলেই
তুমি আমাদের সন্তান ...
ভাই এল পেছন থেকে, জড়িয়ে বলল, দিদি চল
ছবি তুলে আসি ... আজ তোকে নিয়ে যাব ফসলের ক্ষেতে
বহুদিন তুই সবুজ দেখিসনি, আমি তো তা জানি!

বেঁচে থাকা মানে কখনো কখনো প্রেমিকের রাগ আর ক্ষোভে
ঘামের গন্ধ লেপ্টে থাকা ... ভালবাসা ভালবাসা অনুভব!
চোখের ইশারায় নিরালায় ডেকে নিয়ে যাওয়া,
বুঝিয়ে দেওয়া, নিরবতায়ও থাকে দোলায়িত করার অসহ্য সুখ সুখ কৌশল।

ঘুম ভেঙ্গে গেলে যদি মনে পড়ে সকালের আলো
আমায় নিচ্ছে ডেকে, করেছে জাগ্রত সত্যি ...
মন যদি যোগাযোগ করে বলে
ওঠো, এবার তোমার সময় হয়েছে, উঠবার
যদি বুকের কোণে  বুঁদ হয়ে থাকে ব্যথা
অন্যায় অমান্য করার তেজ যদি সূর্য্যের মত হয়
ওটাকেই বেঁচে থাকা বলে!

যদি শত মানুষের ভিড় থেকে সমস্বরে চিৎকার ওঠে আকাশে স্বাধীনতার ...
তবে মনে পড়ে বেঁচে আছি ...




শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০১৩

এই পৃথিবীটা, বলতে আমি বোঝাচ্ছি মূলত
পৃথিবী আদতে যতটা বিশাল, সে কথা নয়।
আজ এই একলা রাত, সেটাই আমার অতি ক্ষুদ্র এক পৃথিবী মনে হচ্ছে।
একাকীত্ব অসহ্য হয়ে ওঠা ঘরে,
ঘোরে আমি বলছি একা একা কথা,
অস্থির হয়ে পায়চারি এক দফা শেষ করে
ভীষণ কষ্টে টেনে টেনে মনকে নিয়ে এলাম, এই পাতায়।
সে আমার কথা শুনছে না!
সে আমাকে একা প্রখর রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
আমি কাঠফাটা রোদে ঠোঁট শুকোনো আবেগ নিয়ে ছটফট করছি, মনের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।
সে ঘরের এক কোণায় ঠাঁয় বসে আছে।
তার অবশ্য আমায় ফেলে বন নদীতে ঘুরে ফিরতে অনুমতির প্রয়োজন পড়ে না।
তবে ইদানীং আমার মতই ওর দশা!
ওর ভাল লাগে না কিছুতে, সে আমার মত অস্থিরতায় ভুগছে।
তাই দরজা বন্ধ করে সেও একা হয়ে রয়! আমাকেও দেখা দেয় না ...
অথচ শুধু আমি জানি, মনের দেখা না পেলে নিঃশ্বাসে বিষ ঢুকে যায়,
মন ছাড়া আমার আর কে আছে এখানে?
পৃথিবী যতটা বিশাল, মন আর আমার নিজস্ব অস্থিরতায়
অস্তিত্ব সংকটে তারো বেশি অনতিক্রম্য দূরত্বে আমরা বিলীন হচ্ছি ...
বিশাল পৃথিবী যেভাবে সময়কে সঙ্গে নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে
তাতে করে মন আর আমার একাকার হয়ে থাকা বড় প্রয়োজন।
... নয়ত আমাদের কে আর সামলাবে?

বুধবার, ২০ মার্চ, ২০১৩

রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অদ্বিতীর শরীরের উত্তাপ বাড়ছে। ঘুম একদম নেই চোখে। কেবল আছে অবসন্নতা, বিষাদগ্রস্ততা। এমন কথা ছিল না। কথা ছিল, কাজ সেরে একসঙ্গে বাড়ি ফেরার। কিংবা এক; দুদিন এদিক সেদিক যদিও বা হয়, পাশে পেলে খুনসুটি করে সারাদিনের ক্লান্তি কাটিয়ে দেবার কথা ছিল। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুণগুণ গান করার কথা ছিল, চুলের গন্ধ নিতে নিতে, আদরের গন্ধে লেপ্টে দেবার কথা ছিল। অথচ সবটাই অধরা মনে হয়। কেন?

অপূর্ব আর অদ্বিতীর পরিচয়টা এমন করেই। ট্রেইনের কামড়ায় বহুদিনের পুরনো ভাল লাগার মানুষটিকে হঠাৎ আবিষ্কারের মত নয় বরং একেবারে অদেখা অদ্বিতীকে অপূর্ব কেমন আকুল করে কাছে টানতে লাগলো। যেন সে বহু আগেই আবিষ্কৃত ছিল তার!

অদ্বিতী তখন বড় একা, অসহায়। জীবন তাকে আরো একবার বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল তার পরম আকাংখিত, নির্ভরতার মানুষ থেকে। খুব ছোট কারণ মনে হবে আপাতদৃষ্টিতে, কিন্তু অদ্বিতী পারেনি মেনে নিতে। যাকে সে এতটা উজাড় করে দিয়েছিল বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যৎ সে তাকে বুঝলো না? তবু সে বোঝাতে চেয়েছিল, যা অভ্র ভাবছে তেমন কিচ্ছু নয়, অপমানে ঋজু হয়ে গেছিল অদ্বিতী, যখন তার মনে হল, তার জীবনের অদ্বিতীয় মানুষটিও পারল না বিশ্বাসের সুতোয় হাঁটতে! সেও ভেবে নিল সাধারণের মত, অদ্বিতীর মনে অন্য কারো বাস, সে ঠকাচ্ছে তাকে! পরিমিত বন্ধুত্ব  আর ভালবাসার মাঝেও সবার জন্য সম্মান অদ্বিতীর মনে, তা জেনেও অভ্র সন্দেহ করল অদ্বিতীকে!  অদ্বিতী তখন ভাবছিল অন্য কোন কিছু। সে ভাবছিল, অভ্রকে সে সাধারণে নামাতে পারবে কি করে? এর চাইতে আলাদা হয়ে যাওয়ায়ই বরং ভালবাসার মান বাঁচে ... অতঃপর মনে পরস্পরের জন্যে কথার ফুলঝুড়ি নিয়ে পরস্পরকে এড়িয়ে চলার সংকল্প। অভ্র আর অদ্বিতী আর কখনো মুখোমুখি হয়নি।

পৃথিবীর রঙ তখন তার কাছে ফিকে। অদ্বিতী জানত, হয়ত অভ্র পারবে একদিন বুঝতে তার ভুল। কিন্তু আত্মঅভিমান গলবে না তাদের কারোই কোনদিন। পৃথিবী এগিয়ে যায়। অদ্বিতী পড়ে থাকে একা। সে কথার মালা গাঁথে, খুঁটিনাটি গল্প করতে ইচ্ছে করে তার। কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে তার ইচ্ছে করে কেউ হাত বাড়িয়ে দিক, জিজ্ঞেস করুক পথে কোন সমস্যা হয়েছিল কিনা, কিংবা নুন, তেল, পেঁয়াজের সাবলীল গল্পই এক দুবার, নতুন কবিতার রস রুপ ছন্দ, আকাশ ফাটানো অট্টহাসির বান, খুব অল্পেতে সুখ খুঁজে ঘুমিয়ে পড়া। নতুন বইয়ের মলাটে উৎসর্গ করা তার নাম দেখতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে অকারণে অচেনা রাস্তায় সেই এক কাউকে পাশে নিয়ে হাঁটতে, পৃথিবীর আদি -অন্তের গল্প আর শুধু দুজনের গল্পে মশগুল হতে ইচ্ছে করে ... হয় না ... শুধু শূণ্যতা থাকে তার পাশে।

এমন জীবনেই অভ্যস্ত অদ্বিতী হাতছানি পায় অপূর্বের একদিন। অপূর্ব তাকে নতুন জীবনের স্বপ্ন বুনতে শেখায়। যে অদ্বিতী অচেনা মানুষ এড়িয়ে চলে, সেই কিনা বলে বসে একেবারেই অচেনা অপূর্বকে তার গোপন কষ্ট আর একাকীত্বের কথা। অদ্বিতী অবাক হয় মাঝে মাঝে। অপূর্ব কেন তাকে বৃষ্টির গল্প বলে, সংসার সাজানোর গল্প বলে, বউকে তার গোপন জীবন বলে ফেলার কথা বলে, ভালবাসার কথা বলে আর অদ্বিতীর নাম কেন বার বার লিখে দেয় খুব কঠিণ কোন আলোচনার মাঝে! ফেইসবুকে এক ঝলক দেখা অপূর্ব দু তিন দিনের কথোপকথনে অদ্বিতীর আমূল জেনে যায়! আর একদিন অবাক করে দিয়ে বলে বসে জীবনসঙ্গী হবার কথা! অন্ধ বিশ্বাস পুঁজি করে অদ্বিতী আরো একবার ভালবাসে। এতটাই ভালবাসে যে নিজেকেও ভুলে বসে!

খুব সুখে ভেসে যায় তারা। কিন্তু এবার ধাক্কা আসে ঝড়ের মত, মীমাংসিত সমঝোতায় মুখ ফেরানো নয়। বরং যেই অপূর্ব ভালবেসে কাছে টেনে নিয়েছিল, অদ্বিতী জানতে পারে, সে তার কাছে লুকিয়েছে তার নষ্ট অতীত। শুধু তাই নয়, অতীতের রেশ অদ্বিতীর আড়ালে জিইয়ে রেখেছে সে! অদ্বিতীর ভাগ সে করে নিয়েছে অন্য আরো অনেকের সাথে। অদ্বিতী বুঝতে পারে, এত নিটোল সম্পর্কেও অপূর্ব যখন তার সবটা লুকিয়ে আদ্বিতীকে বিয়ে করেছে আর সঙ্গে করে বয়ে বেড়াচ্ছে অতীতের নোংরা অভ্যাসের সঙ্গিনীদের, সেখানে তবে কি আর অবশিষ্ট আছে? ভালবাসা কোথাও নেই, বিশ্বাস নেই কোথাও কি? তবু বারবার অপূর্বকে প্রশ্ন করেছে সে, কারণ জানতে চেয়েছে। অপূর্ব তিরষ্কার করেছে, এড়িয়ে গেছে। অদ্বিতী শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর মিলাতে পারেনি। কেন অপূর্ব অদ্বিতীকে বেছে নিয়েছিল? কেন অনুভূতির সম্পর্ক গড়েছিল তবে? কেন স্বপ্ন দেখিয়েছিল? বারবার জানতে চেয়েছে একটাই কথা, মানুষ একই সঙ্গে কি করে পারে, বিশ্বাস অর্জন করে বিশ্বাসঘাতকতা করতে?! ... পায়নি, অপূর্ব বলেছে, ওসব তার ভুল ছিল, অদ্বিতী মানতে পারে না। ভুল সেটা তখন যখন সংশোধনের তাড়া থাকে, অনুশোচনা থাকে। কারো বিশ্বাসকে ঠকিয়ে অশ্লীলতা ভুল হতে পারে না কখনো।

কিন্তু অদ্বিতী পারে না। হেরে যায় ... কতবার কতভাবে অপূর্বকে সে ছেড়ে যেতে চায়, পারে না। আত্ম অভিমানও পা আটকে ধরে অদ্বিতীর। অপূর্বকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে পারে না অদ্বিতী। যতবার ভাবে দূরে যাবে, ততবার আরো অসহায় হয়ে পড়ে সে! সে বুঝতে পারে, অপূর্বকে ছেড়ে থাকতে সে পারবে না! নিজেকে ধিক্কার দেয়, কি করে এত দূর্বল হল সে! যেই অপূর্বের মুখের দিকে তাকালে অদ্বিতী সব কষ্ট ভুলে যায় সে তাকে এভাবে ছোট করেছে, এভাবে ঠকিয়েছে ভাবতে পারেনা সে। কি করে মানবে অদ্বিতী অপূর্বকে? অথচ গোটা পৃথিবীতে অদ্বিতীর ওই এক অপূর্বই আছে ভালবাসার।

সেই থেকে এক ছাদের নিচে তাদের ভিন্ন আবাস। আদ্বিতী জানে না, অপূর্ব এখনো তার পুরনো অভ্যাস জিইয়ে রেখেছে কিনা! কিন্তু তার জানতে ইচ্ছে করে, অপূর্ব তাকে ভালবাসে তা, তার ইচ্ছে করে অপূর্বকে নিয়ে আবার শুরু থেকে শুরু করতে, যেখানে অপূর্ব কিচ্ছু লুকাবেনা তার কাছে। অপূর্ব অদ্বিতীর কপালে চুমু এঁকে বলবে, তোমাকেই শুধু ভালবাসি ... এমনটা হয় না।

রাত দীর্ঘ হয়, সময় ছুটে চলে। এক ছাদের নিচে দুটো মানুষ দিনে দিনে দূরে সরে যায় ... এক ঘরে আলো জ্বলে, অন্য ঘরে অদ্বিতী জ্বরের ঘোরে ছটফট করে ওঠে, তার মনে হয়, অপূর্ব এসে ওর কপালে হাত ছোঁয়ালেই সব জ্বর দৌড়ে পালাবে, কিন্তু এমন হয় না। কারণ, অপূর্বের পরম আকাংখিত হাত যে মূহুর্তে অদ্বিতীর কপাল ছোঁবে, ভালবাসার অপমানে সে মূহুর্তেই মৃত্যু হবে অদ্বিতীর ...

অদ্বিতীর বিচ্ছিন্নভাবে কখনো অভ্রের কথা মনে পড়ে। কে আসলে ভুল ছিল, কে আসলে ঠিক?